বিবাহকে কঠিন করার পরিণাম সমাজে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বেড়ে যাওয়া

Bouquet of rose
Photo credit: Shahista Fatima, via pexels[dot]com/photo/flowers-roses-bouquet-love-12073/
বিবাহ একটি সুন্নত। রাসূলের স. সুন্নত। সুন্নত এই অর্থে যে স্বয়ং রাসূল স. বিবাহ করেছেন। মুহাদ্দিসদের পরিভাষায় রাসূলের স. যে কোনো কথা, কাজ বা সমর্থনই সুন্নত। ফিকহের পরিভাষায় সুন্নত ভিন্ন। ফিকহের সুন্নত হলো ফরয-ওয়াজিব ও মানদুব-মুস্তাহাবের মাঝামাঝি একটি পর্যায়। যা করলে সওয়াব হবে, তবে ছাড়লে গোনাহ হবে না, যদি মুয়াক্কাদা না হয়।

ফিকহের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবাহ ফরয-ওয়াজিব-সুন্নত-মুস্তাহাব-মাকরূহ সবই হতে পারে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে। সাদামাটাভাবে বললে (ফাতওয়ার ভাষায় নয়) এভাবে বলা যায় যে, ব্যক্তির বিবাহের চাহিদা তীব্র হলে এবং হারামে লিপ্ত হওয়ার শঙ্কা থাকলে, সাথে স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে সক্ষম হলে তা পরিস্থিতি ভেদে ফরয-ওয়াজিব হবে। ভরণপোষণ দিতে না পারলে তা মাকরূহ হতে পারে। আর স্বাভাবিক অবস্থায়, চাহিদা তীব্র না থাকলে বা হারামে লিপ্ত হওয়ার শঙ্কা না থাকলে, তা সুন্নত-মুস্তাহাব হবে।

এখন এই যে চাহিদা তীব্র হওয়া বা না হওয়া, বা হারামে লিপ্ত হওয়ার শঙ্কা থাকা বা না থাকা – এই ব্যাপারটি চারপাশের দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে। বর্তমানে প্রিন্ট-ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, ইন্টারনেট, ফ্যাশন শো, বিভিন্ন বার, বৈধ পতিতালয়, হারামে উত্তেজিত করা গান-নাটক বা পর্ণোগ্রাফি ইত্যাদি সবই হারামে লিপ্ত হওয়ার শঙ্কাকে বাস্তবে রূপ দেয়।

চারপাশে নষ্ট হওয়ার এত সব উপকরণ থাকাবস্থায় বর্তমানে একটি প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে বা মেয়ের নষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক, নষ্ট না হওয়াটা অস্বাভাবিক, অভাবনীয়। ভালো থাকাটা অতুলনীয় গুণ বলে বিবেচিত। যেখানে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে কার কয়টা গার্লফ্রেন্ড আছে, তার ভিত্তিতে ব্যক্তির সম্মান নিরূপিত হয়, সেখানে আমাদের দাবীটি অবাস্তব নয়।

এ অবস্থায় ফিকহী গবেষণা কী বলবে তা গবেষকরা বলবেন, তবে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে আমার মনে হয়, প্রত্যেক সামর্থ্যবান প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ের সময়মত বিবাহ করা/ দেয়া ওয়াজিব। এই দায়িত্ব পিতা-মাতা, পরিবার ও সমাজ সবার।

পিতা-মাতার দায়িত্ব সন্তানকে সময়মত বিবাহ করতে সাহস দেয়া, বিবাহ পরবর্তী দায়িত্ব কাঁধে নেয়ার যোগ্য করে তোলা এবং বৈবাহিক সম্পর্কের ব্যাপারে সচেতন করে তোলা। আশ্চর্য! স্কুলে শরীর সম্পর্কে সচেতনতার শিক্ষা দেয়া হয়, এইডস সম্পর্কে সচেতনতায় বিলবোর্ড হয়, কিন্তু বিবাহ করতে উৎসাহ দিয়ে কিছু করা হয় না।

পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব বিবাহকে সহজ করে দেয়া। ইসলামে বিবাহ খুব সহজ। সর্বনিম্ন মোহর কোন ফিকহের মতে দশ দিরহাম, আবার কোন কোন ফিকহে কোনো সর্বনিম্ন মোহরই নেই। (মালয়েশিয়ায় সর্বনিম্ন মোহর একশ রিঙ্গিটেরও – আড়াই হাজার টাকা – কম।) তাছাড়া মোহর পুরোটাই বা আংশিক বাকী রাখা যায়।

মোহর দিবে ছেলে। মোহরের ইংরেজি করা হয় dowry যার বাংলা যৌতুক। সে হিসেবে যৌতুক দিবে ছেলে, মেয়েকে। কিন্তু হয় উল্টো। তাই মেয়েপক্ষ মেয়েকে বিয়ে দিতে সাহস পায় না। জন্মের পর থেকেই ফিক্সড ডিপোজিট করা শুরু করে।

বিবাহের ওয়ালীমাও খুব সাধারণ হতে পারে, এবং ওয়ালীমাটা হবে ছেলে পক্ষের থেকে। অযথা মেয়ে পক্ষের ওপর সবকিছু চাপিয়ে দিয়ে বিষয়টাকে জটিল করার কোনো মানে হয় না। আবার সাথে যোগ হয় এনগেজমেন্ট, আকদ, গায়ে হলুদ ইত্যাদি নানা অনুষ্ঠান।

বিয়ের বয়স প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সাথে সাথেই। তবে ছেলেদেরকে স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে হয়, কাজেই কিছুটা স্ট্যাবল হয়ে নিলে ভালো। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ত্রিশের আগে বিয়ে করাই যাবে না। রাসূল স. পঁচিশ বছর বয়সে বিয়ে করেছেন, এটা একটা বেঞ্চমার্ক হতে পারে। আবার পিতা-মাতা সামর্থ্যবান হলে সন্তানকে সহযোগিতা করতে পারেন। ভালো চাকুরী না হলে বিয়ে করা যাবে না, বড় ভাইয়ের আগে বিয়ে করা যাবে না, ছোট বোন এখনো বাকী – এসব সামাজিক বাধা দূর করে বিয়েকে সহজ করে দিতে হবে।

বিবাহ একটি পুরুষকে দায়িত্বশীল করে, প্রোডাক্টিভ করে এবং সমাজে ইকোনমিক ভ্যালু এ্যাড করে। বিবাহের কারণে আসা রেস্পন্সিবিলিটি পুরুষের সময়কে মূল্যবান করে তোলে, অর্থব্যবস্থা থেকে তার চাহিদা বেড়ে যায়, ফলে অর্থব্যবস্থায় তাকে আরো বেশি কাজ/প্রোডাক্ট যোগান দিতে হয়। আমাদের দেশের রাস্তায় রাস্তায় চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়া, সিগারেটে ফুঁক দেয়া, বা এলাকায় মাস্তানি করা, মিছিলে যোগ দেয়া মানুষগুলোর একটি বড় অংশই বেকার এবং অবিবাহিত। অর্থব্যবস্থা তাদের কাছ থেকে কোনো ইনপুট পায় না।

আমাদের জনৈক সাবেক মন্ত্রী হজ্জের ইকোনমিক ভ্যালু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। অথচ হজ্জ্ব ফরয হয় সামর্থ্যবানদের ওপর, হজ্জ্বের জন্য সে সামর্থ্য অর্জন করতে ব্যক্তিকে আয় করতে হয়, সঞ্চয় করতে হয়, বিনিয়োগ করতে হয়, অর্থব্যবস্থাকে অনেক কিছু দিতে হয়। এর সবকিছুর জন্য দায়িত্বশীল হতে হয়, যার জন্য বিবাহ অপরিহার্য। প্রত্যেক হাজী অর্থব্যবস্থাকে অনেক কিছু দিয়ে পরে হজ্জ্বে যান। সেখান থেকে আল্লাহ তায়ালার রহমত ও হালাল মোটিভেশন নিয়ে এসে পুনরায় অর্থব্যবস্থাকে হালাল ইনপুট দেন।

আফসোস! ভদ্রলোক সমাজের এসব ছেলে-পেলেকে দেখেন নি। যারা দিন-রাত-মাস-বছর আড্ডা দিতে দিতে কাটিয়ে দেয়। মাদকসেবীদের তিনি দেখেন নি, যারা অর্থব্যবস্থাকে কিছু দেয়া দূরের কথা, উল্টো নিজেকে অর্থব্যবস্থার বোঝা বানিয়ে রাখেন। আর এই আড্ডাবাজ গ্রুপের একটি বড় অংশই অবিবাহিত।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতিটি বিধান না মানার একটি পরিণাম আছে। বিবাহের বিধানকে কঠিন করার পরিণাম সমাজে যিনা বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বেড়ে যাওয়া। আর সমাজে যিনা বেড়ে যাওয়া কিয়ামতের অন্যতম একটি আলামত। সে হিসেবে বিবাহ কঠিন করাটা কিয়ামতের আলামত।

মানবরচিত আইন খুব হাস্যকর। নারী-পুরুষ একে অপরকে স্বেচ্ছায় সঙ্গ দিলে বা রাত কাটালে সেটা কোনো অপরাধ নয়, সেটা প্রেম-ভালবাসা ইত্যাদি। অপরাধ তখনই, যখন এক পক্ষ (বিশেষত নারী) দাবী করবে যে, তার ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ করা হয়েছে, যার পারিভাষিক পরিচয় ধর্ষণ। তাহলে ধর্ষণ মাপার মাপকাঠি হলো, নারীর ইচ্ছা থাকা-না থাকা। ওদিকে আঠারোর আগে নারী প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তার কোনো ইচ্ছা নেই। কাজেই যতই স্বেচ্ছায় করুক, সেটা ইচ্ছা নয়। বাই ডিফল্ট তা বলপ্রয়োগ, এবং ধর্ষণ। আঠারোর পর স্বেচ্ছায় হলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু মামলা করলে তা ধর্ষণ, ঘটনার কয়েক মাস বা কয়েক বছর পরে করলেও।

মানবরচিত আইন প্রকারান্তরে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ককে উৎসাহ দেয়। এবং ছোট একটি সুতো দিয়ে অপরাধের জায়গাটাকে আলাদা করার চেষ্টা করে। ফলে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে বেড়েই চলে, ধর্ষণ হতেই থাকে, ধর্ষিতারা আত্মহনন করতেই থাকে। ওদিকে আল্লাহ তায়ালার আইন ধর্ষণের শুরুতেই টুটি চেপে ধরে।

বিবাহ যতদিন কঠিন থাকবে, ততদিন ধর্ষণ ও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক সহজ থাকবে। এর পরিণাম কী, তা আর বলার প্রয়োজন নেই। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। আমীন।

লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় এখানে: https://www.facebook.com/myousufs/posts/10205572616823034 

আরও পড়ুন:

7 comments

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান