হাদিসের দৃষ্টিতে কুরআনকে দেখব? নাকি, কুরআনের আলোকে হাদিসকে বুঝব?

কুরআন আর প্রচলিত হাদিসগ্রন্থগুলোর মধ্যে সম্পর্ক আমি অনেকটা টেক্সট বই আর গাইড বইয়ের মতো চিন্তা করি। টেক্সট বইয়ের আলোচ্য বিষয়গুলোই কিছুটা বিশদভাবে গাইড বইয়ে বলা থাকে। গাইড বইয়ে কোনো ভুল আছে কিনা সেটা টেক্সট বই দ্বারা বিচার করা হয়, উল্টোটা নয়। গাইড বই টেক্সট বইয়ের বিপরীত কোনো কিছু বলতে পারে না।

একইভাবে হাদিস বুঝতে হবে কুরআনের আলোকে। হাদিসের ভুল-শুদ্ধ যাচাই করবে কুরআন। কুরআনই নিজেকে মিযান (পরিমাপক), ফুরকান (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী) বলে পরিচয় দেয়। তাই হাদিসকে কুরআনের কোনো আয়াতের ওপর প্রাধান্য দেওয়া বা হাদিস দ্বারা কুরআনের কোনো আয়াতকে রহিত করে দেওয়া ঠিক বলে মনে হয় না।

অন্যদিকে সুন্নাহ (নামায, রোযা, হজ, যাকাত এরকম সবার পরিচিত আমলগুলো) আর হাদিসের সম্পর্ক তুলনা করা যায় ভাষা এবং ডিকশনারি (বা গ্রামার বই)-এর সম্পর্কের সাথে। ডিকশনারিতে একটা শব্দ আছে, এ কারণে কিন্তু আমরা সেটা আমাদের আলাপে ব্যবহার করি না। বরং আমরা কথাবার্তায় একটা শব্দ ব্যবহার করি বলেই সেটা ডিকশনারিতে যোগ হয়।

নামায, রোযা ইত্যাদি আমলগুলো রাসুল (সাঃ) বা তাঁর আগেকার নবিদের সময় থেকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম চর্চা হয়ে আসছে বিধায় সেগুলোর কথা হাদিসগ্রন্থগুলোয় পাওয়া যায়, এর উল্টোটা নয়। কুরআন, সুন্নাহ এবং হাদিস প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আমাদের কাছে পৌঁছানোর পদ্ধতির প্রকৃতি ভালোমতো খেয়াল করলে বিষয়গুলো উপলব্ধি করা আরো সহজ হয়ে যায়।

বর্তমানে হাদিস বলতে আমরা যা বুঝি সেগুলো ঐতিহাসিক দলিল (historical records), কুরআনের মতো ˹আল্লাহর পক্ষ থেকে সরাসরি নাযিল হওয়া˺ পবিত্র কোনো ওহী না — এই কথাটা ড. আকরাম নাদভি ও জাভেদ গামিদিকে অনেক সময়ই বলতে শুনেছি।

কুরআন ও সুন্নাহ আকারে যেই দ্বীন আমরা রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছ থেকে পেয়েছি, তারই বিচ্ছিন্ন-অবিছিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায় হাদিসে। এগুলো যথাসম্ভব শুদ্ধ করে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন আমাদের পূর্ববর্তী পণ্ডিতগণেরা। হাদিস বোঝার ক্ষেত্রেও তাঁরা বিভিন্ন মূলনীতি দাড় করিয়েছেন (এবং সেগুলো খুবই যুক্তিযুক্ত)।

এছাড়াও এসব হাদিসগ্রন্থে দ্বীনের সাথে সম্পর্কিত না এমন নানা কথাও খুঁজে পাওয়া যাবে। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা হওয়ায় এতে কোনো ত্রুটি থেকে থাকা খুবই স্বাভাবিক, যেকারণে এখনো জ্ঞানপিপাসু আলেমরা হাদিসগুলো নিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

এই পয়েন্টগুলো মাথায় না রাখা, হাদিসকে ইসলামের স্বতন্ত্র বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট উৎস মনে করা, হাদিসকে কুরআনের ওপর (ইনডাইরেক্টলি) প্রাধান্য দেওয়া, হাদিস ও সুন্নাহ টার্ম দুটোকে এক করে ফেলা, সুন্নাহকে একাধিক অর্থে ব্যবহারসহ অন্যান্য কারণে দুটো প্রান্তিক মানসিকতার উদ্ভব হয়েছে।

এক শ্রেণী সব হাদিসকেই চোখ বুজে ১০০% সত্য মনে করে, তার থেকে একটু এদিক ওদিক হলেই ইসলাম থেকে বিচ্যুতি মনে করে (Hadith dogmatism)। নির্দিষ্ট কোনো একটা হাদিসের বিপরীতে কথা বললেই আহলে কুরআন ট্যাগ দেয়।

অন্যদিকে হাদিসগ্রন্থে কিছু হাদিস ত্রুটিপূর্ণ মনে হওয়ায় আরেক গ্রুপ পুরো হাদিসভাণ্ডারকেই শয়তানের কাজ মনে করছে (Hadith rejection)। কুরআন থেকেই আবার নতুন করে নামাজ-রোযার নিয়ম তারা বের করছে!

আমার মনে হয় হাদিস নিয়ে আমাদের অ্যাপ্রোচটা হওয়া উচিত এর মাঝামাঝি (Hadith relativism)।

<>

হাদিসের ওপর ইমাম আমিন আহসান ইসলাহির ‘Fundamentals of Hadith Interpretation’ নামে ছোট আকারের চমৎকার একটা বই আছে। আগ্রহ থাকলে পড়তে পারেন।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান