কাতার বিশ্বকাপ এবং ইসলামিস্ট ও কালচারাল মুসলিমদের ক্যাচাল

ইসলামের একটা কালচার আছে। এই কালচারের ভেতর ধার্মিক-অধার্মিক সব ধরনের মুসলিম থাকতে পারেন। নামকাওয়াস্তে মুসলিমও হতে পারেন এই কালচারের চিহ্ন।

আমাদের অনলাইন তলাবাদের অনেকের বিশ্বাস: কেউ পুরোপুরি সাধুসন্তু না হলে তার মধ্যে ইসলামি কালচার থাকলেও তিনি ত্যাজ্য। মরক্কো, তিউনিসিয়ার খেলোয়াড়েরা এজন্য বিজয়ের পর সিজদায় লুটিয়ে পড়ার পরও তাদের কাছে বিচ্যুত।

কাতারের বিশ্বকাপ সামগ্রিকভাবে আরব ও ইসলামি কালচার যেভাবে দুনিয়ার সামনে এনেছে তা আগে কখনো হয়নি। ইসলাম ও আরব দুনিয়াকে এভাবে ঝাঁকে ঝাঁকে অমুসলিমেরা কখনো সামনাসামনি দেখেননি। দেখার প্রয়োজনও মনে করেননি। বিশ্বকাপের উছিলায় তারা নিজেরা টের পেয়েছেন ‘রক্ষণশীল’ আরব সমাজ নারীদের জন্য কত উপকারী। কেভিন পিটারসনের মতো ক্রীড়াবিদেরা বলতে বাধ্য হয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্য এমন এক পরিবেশ যেখানে বাবা-মা-সন্তান নিয়ে একসাথে বসে সময়টা উপভোগ করা যায়। সভ্যতা আর গণতন্ত্রের সবক শেখানো কোনো পশ্চিমা দেশ এত নির্বিঘ্ন পরিবার-বান্ধব নারীবান্ধব আন্তর্জাতিক কোনো ইভেন্ট এখন পর্যন্ত আয়োজন করতে পারেনি।

আমাদের অনলাইন তলাবাদের কারও কারও চিন্তা সব সময় বাইনারি। তারা সম্ভবত বিশ্বকাপ থেকে মাহফিলের ফল আশা করেন। যে-কারণে তাদের ফিল্টারে কাতার বিশ্বকাপের যেসব দিক ‘ইসলামি’ কালচারকে ফোটায়, সেগুলোও আটকে যায়।

কাতার যেবার বিশ্বকাপ আয়োজনের অনুমতি পেল, পশ্চিমা বাকস্বাধীনতার ধ্বজাধারীরা সেই ২০১০ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যে বিশ্বকাপ আয়োজনের বিরোধিতা করে আসছে। নিয়মিত নানা প্রোপাগান্ডা চালিয়েছে। এই তো সেদিন, বিশ্বকাপ শুরুর আগের দিনেও মাঠে বিয়ার বিক্রি করা যাবে না দেখে কত কিছু বলল ওরা। বিশ্বকাপ যেদিন শেষ, মেসির গায়ে ‘বিশত’ পরানো নিয়েও ওদের কত অ্যালার্জি।

ইউরোপ আর অ্যামেরিকার মিডিয়া সামগ্রিকভাবে আরব আর ইসলামি কালচারকে যে কী জঘন্য চোখে দেখে—কালোদের চেয়েও নীচু চোখে—সেটা যে এভাবে নগ্ন হয়ে বের হলো, দুনিয়ার বেবাক মানুষের সামনে স্পষ্ট হলো। যে-কাজটা আমাদের সব আলিম-তলাবারা ৩৬৫ দিন মাহফিল করেও আমজনতার দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিতে পারতেন না, সেটা কাতারের বিশ্বকাপ যে কী অবলীলায় করে দিল, আমাদের তলাবাদের এটুকু স্বীকার করতে কোথায় এত কষ্ট?

আরব ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলিতে মানুষের কাজেকর্মে কথায়-বার্তায় ইসলামি কালচারের নিদর্শন হামেশা পাওয়া যায়। হতে পারে খুশিতে সিজদা দেয়া লোকটার মুখে দাড়ি নেই। নিয়মিত নামাজ পড়েন না। কিন্তু এই যে আনন্দে সিজদা দিতে হয় এটা বাংলাদেশের কটা মুসলিম—এমনকি ধার্মিক মুসলিম—জানে ও পালন করে? পশ্চিমে সেলিব্রেশন মানে গার্লফ্রেন্ড আর নাজায়েজ আওলাদ নিয়ে মাঠে ঘুরঘুর। কিন্তু কাতারে আমরা দেখলাম, উদ্‌যাপন মানে নাড়ির সঙ্গে যোগ। মা ও ছেলের নিবিড় উষ্ণ আলিঙ্গন।

শারিআর চোখে মাপলে বিশ্বকাপ বা এ-ধরনের আয়োজন নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকবে। এগুলোর উপযোগিতা, মুসলিম বিশ্বে এসবের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়েও কথা চলবে; চলা উচিতও। কিন্তু যেখানে প্রতিপক্ষ পশ্চিমা মিডিয়া আর তাদের ভণ্ডামি, আর এপাশে আরব ও মুসলিম কালচার ও পরিবেশ, তখন একজন সাধারণ মুসলিম হিসেবে আমাদের কোন পাশে দাঁড়ানো দরকার?

কাতার বিশ্বকাপের আগে মুসলিমরা ফুটবল দেখত না, খেলত না—এমন তো না। সাউদি আরাবিয়া প্রথম বিশ্বকাপ খেলেছে সেই ১৯৯৪ সালে। মরক্কো তো তারও আগে—সেই ১৯৭০ সালে। বিশ্বকাপের সিজনাল দর্শক বাদ দিলেও বাংলাদেশি-পাকিস্তানি তরুণ-যুবাদের একটা বিশাল অংশ ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, স্প্যানিশ লা লিগা আর চ্যাম্পিয়নস লিগের পাঁড় ভক্ত। কিন্তু আম-সমাজ থেকে দূরে থাকা আমাদের অনলাইন তলাবাদের কারও কারও কথা শুনে মনে হচ্ছে, কাতার বিশ্বকাপ দিয়ে মুসলিমরা ফুটবল চিনল। ফুটবলের ইসলামাইজেশন করল।

আমাদের শিল্প-সাহিত্যে ইসলাম নেই। কাজের পরিবেশে ইসলামিক কালচার নেই। চলতে-ফিরতে আমাদের কথাবার্তায় ‘মুসলিম’ পরিচয় পাওয়া যায় না। রাস্তায় বের হলে একটা অমুসলিম দেশের পথঘাটের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য সামান্য। ইসলাম ও মুসলিম নানা অনুষঙ্গকে এই দেশে এখনো বাঁকা চোখে দেখা হয়। যে-ছেলেটা যে-মেয়েটা জন্মেই দাড়িময়-হিজাবময় পরিবেশ পেয়েছে, তার জন্য বাইরের রাস্তার দাড়িহীন-বেপর্দা ছেলেমেয়েদের নিয়ে কথা বলা খুব সোজা। কিন্তু তাদের কাছে ইতিবাচকভাবে ইসলাম ও মুসলিম কালচার ফুটিয়ে তোলা, চিরচেনা খোলস পাল্টে অভিনবভাবে উপস্থাপন করে ধীরে ধীরে আগ্রহী করে তোলা বড় কঠিন। ইংরেজিভাষী সেলিব্রেটি ‘দা’ঈরা সেই কঠিন কাজটা এমনভাবে করছেন ও করেন, যা আমাদের লোকাল তলাবাদের পক্ষে অসম্ভবের চেও বেশি কিছু।

ইসলামের কথা শোনার বা জানার পরদিন থেকেই কেউ আদর্শ মুসলিম হয়ে যায় না। অনেকে কখনোই হয় না। কেউ আজ হয়, কাল ছাড়ে, পরশু ফের ধরে। ইসলাম পালন প্রতিটা দিন এক একেকটা নতুন চ্যালেঞ্জ। কাতার বিশ্বকাপ নানা দিক থেকে ইসলামের কিছু বার্তার সর্বজনীনতার সবুত দিয়েছে। আমাদের এমন কিছু মুসলিম কালচারের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে, মুসলিম হয়েও যেগুলো আমাদের আজন্ম অজানা। পুরোপুরি তো নয় অবশ্যই; তবে কিছু চ্যালেঞ্জ সহজ করেছে আলবত। কাতারে বিশ্বকাপ না হলে এসব সবুত মিলত না—আমি তা-ও বলি না। কিন্তু বিশ্বকাপ হওয়ায় যে-ফায়দাটা পাওয়া গেল, সেটা কেন নেব না?

কালচারকে ঠিকমতো ইস্তেমাল করার প্রক্রিয়া না জানার কারণে গায়ের আর মুখের জোরের আশ্রয় নিতে হয়েছিল পশ্চিমা পাকিস্তানিদের। ফলে পাকিস্তানি কালচার তো দূর হয়েছেই, ইসলামি কালচারও আমাদের থেকে হারিয়েছে। অন্যদিকে চৌকস ইন্ডিয়ানরা আকাশ-সংস্কৃতির প্যাকেটে সবার অগোচরে কী অনায়াসে ঢুকিয়ে দিয়েছে হিন্দু সংস্কৃতি। মুসলিম হয়েও আমাদের বঙ্গীয় মুসলিম সমাজে ইসলামি কালচার আজ তাই হারিয়ে যাওয়া মসলিন কাপড়—স্মৃতিতে আছে, পরশে নেই।

গণ্ডির ভেতরে আদর্শ সমাজ। ওই সমাজে যে-কথা যে-চর্চা খাটে, বাইরে সেই কথা সেই চর্চা খাটে না। এখানকার সমাজ বহু ঢঙে ভাঙা। বন্দি চিন্তায় তামাম দুনিয়াকে একপাশে রেখে নিজে রাজা সাজা যাবে। ফাঁকে দিয়ে বিদেশি প্রতিবেশী এসে ‘ভিজেয় দিওয়াস’ করে দেবে। হাজারো প্রতিকূলতার এই সময়ে নিজেদের কালচারের প্রচার, যেখানেই হোক, বরণ করে এগিয়ে না এলে আপন বনে রাজা বনে দেওঘরের বন্দি থেকেই দিন যাবে।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান