ইবনু মাসউদ: প্রকাশ্যে কুরআন পাঠকারী প্রথম সাহাবী

Quran Kaba

ইয়াসির ক্বাদি-র লেকচার অবলম্বনে

তখন নবি ﷺ ছাড়া আর কেউ জনসমুখে কুরআন পাঠের সাহস পেতেন না । তো, একদিন আরকামের বাড়িতে জড়ো হয়ে সাহাবিরা বলাবলি করছিলেন, নবিজির সাথে আর কে কুরআন পাঠ করবে জনসমুখে স্বেচ্ছায় । কেউ সাহস পাচ্ছিলেন না । মাঝ থেকে ইবনু মাসউদ বলে উঠলেন, “আমি পড়ব ।”

সাহাবিরা আপত্তি করে বললেন, না, তুমি না, অন্য কেউ । কারণ, ইবনু মাসউদ মাক্কার কেউ নন । কুরাইশদেরও কেউ নন । বহু দূরের ইয়েমেনের বাসিন্দা । তিনি এভাবে কুরআন পাঠ করলে যেকেউ তার উপর চেপে বসতে পারবে । তাকে রক্ষা করার কেউ নেই এখানে ।

ধরুন, আপনার যদি একটা অ্যামেরিকান পাসপোর্ট থাকে, আর আপনাকে অন্য কোনো দেশে কেউ কোথাও আটকায়, অ্যামেরিকান পাসপোর্টের জোরে আপনি অ্যামেরিকা সরকারের সহায়তা পাবেন । আমেরিকান মুসলিম হলে অবশ্য ভিন্ন কথা! যাহোক, তখন মাক্কার অবস্থা ছিল অনেকটা এমন । আপনি যদি কোনো গোত্রের হতেন, তা হলে সেই গোত্র আপনাকে সুরক্ষা দেবে । ইবনু মাসউদ ছিলেন পরদেশি । তাই সাহাবিরা বললেন তুমি না, অন্য কেউ । তুমি জনসমুখে পাঠ করলে তোমাকে মারধোর করলে কেউ তোমাকে বাঁচাতে আসবে না ।

কিন্তু ইবনু মাসউদ রা. তাঁর কথায় অনঢ় । তিনি বললেন, “না, আমিই পড়ব । আমি আল্লাহর উপর ভরসা করেছি । তিনি আমায় রক্ষা করবেন ।”

সুবহান আল্লাহ! এই হলেন ইবনু মাসউদ । নবিজি যার সম্বন্ধে বলেছিলেন, “কুরআন যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছে যদি সেভাবে পড়তে চাও, তা হলে ইবনু মাসউদের কাছে শেখো ।”

সত্তরেরও অধিক সূরা তিনি সরাসরি শিখেছিলেন নবিজির থেকে । কুরআনের অন্যতম অভিজ্ঞ ছিলেন তিনি । কুরআন ছিল তার অদম্য আগ্রহের বিষয় । তো, তার এমন দৃঢ়তা দেখে, সাহাবিরা আর না করলেন না ।

পরের দিন সকালে তিনি কাবাঘরের সামনে গেলেন । তখন লোকজন জড়ো হবার সময় । ওই সময়ে কাবাঘরের আশপাশ ছিল কুরাইশদের আড্ডা দেয়ার জায়গা । কাজবাজ শেষ করে তারা এখানে জড়ো হতো । খোশগল্প করত । তো, ওরকম একটা সময়কেই বেছে নিলেন ইবনু মাসউদ । তিনি সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন মাকাম ইবরাহিমের উপর । তারপর সুন্দর মধুমাখা কণ্ঠে কুরআন পাঠ শুরু করলেন: আর-রাহমান, আল্লামাল-কুরআন, খালাকাল-ইনসান, আল্লামাহুল বায়ান… ।

একে তো ছান্দসিক আয়াত, তার সাথে ইবনু মাসউদের মধুঝরা কণ্ঠ—সব মিলিয়ে এক সম্মোহনী পরিবেশ । আলোর দিকে ছুটে আসা পঙ্গপালের মতো আশপাশের সব কুরাইশ ছুটে এল ইবনু মাসউদের কাছে । ইতিউতি একে অন্যের দিকে চেয়ে বলাবলি করছিল, এই লোক এটা কী পড়ছে । এরকম সুরে-ছন্দে তো আগে কেউ কখনো কোনো আরবি পঙ্‌ক্তি আবৃত্তি করেনি । তাজউইদের নানা নিয়ম তখন আরবদের জানা ছিল না । গুন্না-মাদ ইত্যাদি নানা মাত্রার ব্যবহারে কুরআনের তিলাওয়াত এক অদ্ভুত তন্ময়তা ছড়িয়ে দিচ্ছিল—কেউ অবশ্য তখনো বুঝতে পারেনি যে এটা কুরআন ।

একদিকে কৌতূহল, অন্যদিকে ঘোর—সবাই মুগ্ধ আবেশে জড়িয়ে । হঠাৎ এক লোক বলে উঠল, আরে মুহাম্মাদ যেটা অবতীর্ণ হবার দাবি করে, এটা তো সেই কুরআন । ব্যস, সাথে সাথে দুচারজন লোক উঠে গেল ইবনু মাসউদকে মারতে । কিন্তু নিবিড় ধ্যানে মগ্ন পাঠে ডুবে থাকা ইবনু মাসউদ তখনও পড়ে চলছেন । একটু আগেই যারা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে শুনছিল, তাদের কেউ কেউ পায়ের জুতো খুলে ছুড়তে লাগল তাঁর দিকে । তিনি তো কুরাইশি নন; কেউ নেই তাঁকে বাঁচাবে । আরও কিছু লোক উঠল, সবাই মিলে বেদম মারা মারতে লাগল তাঁকে । আর পড়তে পারলেন না তিনি । আঘাতে-বেদনায়-রক্তে জর্জরিত মুখ নিয়ে এক চিলতে হাসি নিয়ে তিনি ফিরে এলেন সাহাবিদের ডোরে ।

সাহাবিরা তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোমাকে তো বলেছিলাম, এরকম কিছু একটা হবে । তবু তো শুনলে না… ।

ইবনু মাসউদ বললেন, “আল্লাহর কসম, কুরাইশদের প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কিছু বাড়েনি । কাল আমি আবারও যাবো, আবারও পড়ব ।”

সাহাবিরা বললেন, “বাস, যথেষ্ট হয়েছে । আর না । ওদের যথেষ্ট পিত্তি জ্বলেছে ।”

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান