কুরআনের তাদাব্বুর কেন করবেন, কিভাবে করবেন

রমজানে আমরা কম-বেশী সবাই কুরআন পড়ি, আলহামদুলিল্লাহ। অনেকে অনুবাদ পড়ি, কেউ কেউ আরো এক ধাপ এগিয়ে তাফসির (ব্যাখ্যা) পড়ি। কিন্তু, কুরআনের একটা দাবিতে আমরা প্রায় সবাই পিছিয়ে – সেটা হচ্ছে কুরআনের আয়াত নিয়ে চিন্তা করা – যেটাকে আরবীতে বলে তাদাব্বুর, আর ইংরেজীতে বলে Contemplation।

অথচ এই তাদাব্বুর করা কিন্তু কুরআনের দাবী। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনে বলেন: اَفَلَا يَتَدَبَّرُوۡنَ الۡقُرۡاٰنَ اَمۡ عَلٰى قُلُوۡبٍ اَ قۡفَالُهَا‏ “ওরা কি কুরআন নিয়ে তাদাব্বুর (গভীর চিন্তা) করে না? নাকি ওদের অন্তরে তালা লাগানো?” [সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:২৪]

এই আয়াতের আগের-পরের কয়েকটা আয়াত পড়ে এর প্রেক্ষাপট (context) যদি দেখেন তাহলে বুঝবেন, এখানে আল্লাহ আসলে মুনাফিকদেরকে বর্ণনা করেছেন। এর মানে দাঁড়ায়, তাদাব্বুর না করে শুধু কুরআন পড়ে যাওয়া মুনাফিকদের একটা বৈশিষ্ট্য।

এই আয়াতের আরেকটি অর্থ এরকমও হয় – যারা নিয়মিত কুরআন পড়ছে, এটা নিয়ে চিন্তাও করছে, কিন্তু তারপরেও তাদের আচার-আচরণ মুনাফিকের মতো রয়ে গেছে – এদের অন্তরে তালা লেগে গেছে – এদের মিথ্যাবাদীতা, অহংকার ও পাপগুলোর কারণে কুরআনের আয়াতগুলো তাদের আচার-আচরণে কোনো প্রভাব ফেলছে না।

তাহলে এটা বোঝা গেল, যে আমাদের তাদাব্বুর করতে হবে। কুরআনের ২-৩টা আয়াত পড়ব, তারপর চিন্তা করব – এই আয়াতটা আমার জন্য কিভাবে প্রযোজ্য? আমার জীবনে এটা আমি কিভাবে এপ্লাই করব? নিজেকে কিভাবে ইম্প্রুভ করব? – এটাই তাদাব্বুর।

অনেকেই তাদাব্বুর আর তাফসীর এর মধ্যে মিলিয়ে ফেলেন। কেউ হয়ত বলবে – আরে আমি তো আরবী জানি না, আমি কিভাবে তাদাব্বুর করব? আমি তো হাদিস জানি না, আমি তো সীরাত জানি না – আমি কিভাবে তাদাব্বুর করব?

মহান আল্লাহ তাদাব্বুর করার জন্য এরকম কোন প্রি-কন্ডিশন দেননি। নবিস মুসলিম যেমন তাদাব্বুর করতে পারে, বিচক্ষন আলেমও তেমনি তাদাব্বুর করতে পারেন। কুরআন এমন একটি গ্রন্থ, যা আপনার জ্ঞানের লেভেল অনুসারে আপনার কাছে ধরা দিবে। আপনি কিছু আয়াত পড়বেন, তাদাব্বুর করবেন, মনে প্রশ্ন আসবে, প্রাসঙ্গিক হাদিস / শানে নুজুল পড়বেন, আবার তাদাব্বুর করবেন, এবার আগের চেয়েও বেশী বুঝবেন, আয়াতগুলো নিয়ে আবার চিন্তা করবেন, নিজের জীবনে কিভাবে এপ্লাই করবেন তা চিন্তা করবেন, আরো প্রশ্ন আসবে, আরো পড়বেন/জানবেন, এভাবে চলতেই থাকবে।

আয়াতের তাফসীর করতে হলে আলেম হতে হয়, তাদাব্বুর করতে হলে হতে হয় না। ইমাম আস-সুয়ুতির মতে একজন তাফসিরবিদকে আরবী গ্রামার, উপমা, আকিদা, ফিকহ, যুক্তিবিদ্যাসহ জ্ঞানের কমপক্ষে ১৫টি শাখায় দক্ষ হতে হয়। তাফসির বলে দেয় আয়াতের প্রকৃত অর্থ, আয়াতে আল্লাহ কী বুঝাতে চাইছেন, কী বুঝাতে চাইছেন না। তাফসিরবিদেরা তাদাব্বুরের সীমা নির্ধারণ করে দেন। একজন তাফসিরবিদ তার তাফসীর গ্রন্থে আয়াতের অর্থের সীমা নির্ধারণ করার পর – তাদাব্বুর করতেও পারেন, আবার না-ও পারেন।

আসুন একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে অনুবাদ, তাফসীর ও তাদাব্বুরের পার্থক্য বুঝা যাক।

আমরা সবাই জানি কুরআনের সূরাগুলো শুরু হয় – “বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম” দিয়ে।

এর অনুবাদ কী? “পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি”।

আপনি শুধু এই অনুবাদটুকু পড়েই তাদাব্বুর শুরু করতে পারেন। আজকে সকাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত মহান আল্লাহর কি কি করুণা, কি কি দয়া আপনি উপভোগ করেছেন? আপনি আরামদায়ক বিছানা ছেড়ে উঠেছেন, সকালে নাস্তা খেয়েছেন, নিজের পায়ে চলাফেরা করেছেন, নিজের চোখে এই লেখাটি পড়ছেন। কত মানুষের পরিবার নেই, আপনার পরিবার আছে। কত মানুষের চেয়ার থেকে উঠে বসার শক্তি নেই আপনার আছে।

এরপর আপনি একই আয়াতের তাফসীর পড়লেন। তাফসীর থেকে আপনি আর-রহমান ও আর-রহিম শব্দের পার্থক্য জানলেন। রহমান বলতে বুঝায় দয়ার প্রচন্ডতা, আল্লাহ ভীষণ দয়ালু এটা বুঝায়। আর রহিম বলতে বুঝায় ঠিক এই মুহূর্তে আল্লাহ আপনার প্রতি দয়া করছেন, প্রতি মুহুর্তে আপনার প্রতি দয়া করে যাচ্ছেন সেটা। রহমান হচ্ছে আল্লাহর সার্বজনীন দয়া যা তিনি সব ধর্মের মানুষকেই দিয়ে থাকেন। আর রহিম হচ্ছে সেই দয়া যা মুসলিমদের জন্য নির্দিষ্ট, বিশেষ করে পরকালে আল্লাহ মুসলিমদের প্রতি রহিম হবেন। এই তাফসীর জানার পর আপনার তাদাব্বুরে ভিন্ন মাত্রা আসবে। আপনি চাইবেন, মহান আল্লাহ শুধু রহমান নয়, রহিম হিসেবেও আপনাকে দয়া করুন।

আমরা যে যতটুকুই জানি, কুরআনের আয়াত পড়ে সেটা নিয়ে চিন্তা করব, তাদাব্বুর করব। ইমাম ইবনুল কায়্যিম এর মতে – তাদাব্বুর করার চাইতে মঙ্গল আর কোনো কিছুই বান্দার দুনিয়া বা আখিরাতের জন্য নেই। তাদাব্বুর, প্রশ্ন, আরো জানা, নিজের জীবনে সেই জানার প্রয়োগ, আবার তাদাব্বুর – এই চক্র চলতেই থাকুক।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান