তাবলীগ জামাতের যত ভালো ও মন্দ

তাবলীগ জামাতের বিরুদ্ধে ইসলামের প্রথম মসজিদ মসজিদে কুবার এক খতিব সাহেবের বক্তব্য অনুবাদ করে ছেড়েছেন কিছু মানুষ। সেখানে তিনি একটা সময় পড়ছিলেন, ‘এই জামাত মানুষকে তাকফির আর সন্ত্রাসের দিকে নিয়ে যায়’। আর তখন ছবিতে দেখাচ্ছিলো টঙ্গির সেই মারামারির কিছু ছবি, যেটা তাবলীগের একশ বছরের ইতিহাসে ঘটা একটা মাত্র অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা!

কি অদ্ভুত শয়তানি মানুষ করে। যে খতিব বক্তব্য দিচ্ছিলেন তিনি না এই জামাতে সময় দিয়েছেন, না জেনে বুঝে বলেছেন। যা পড়তে বলা হয়েছে দেখে দেখে তা পড়েছেন। নইলে যেই জামাত পারলে কাফিরকেও ভালো করে কাফির বলার মতো না তাকে বানিয়েছে তাকফিরি! যে জামাতের লোকেরা নম্রতা ব্যবহারে সুফি দরবেশকেও হার মানায় তাকে বানিয়েছে সন্ত্রাসী! মিথ্যাচারের সীমা থাকা উচিৎ ছিল কিছুটা অন্তত।

তাবলীগ জামাতের মূল্যায়ন চাইলে যে কেউ করতেই পারে। ভালো মন্দ সব জামাতের মধ্যেই আছে। তবে সেটা হওয়া উচিৎ ইনসাফের ভিত্তিতে। কল্যানকামীতার নিয়তে। যে বিশাল জামাত সারা দুনিয়ায় আখিরাত ভোলা মানুষগুলোকে আখিরাতের প্রতি আগ্রহী করছে তার প্রাপ্য স্বীকৃতি দিতে কৃপণতা কেন!

< >

একজন সাধারণ মানুষকে তাবলীগের পজিটিভ বিষয় বোঝানো খুব সহজ। কিন্তু নেগেটিভ বিষয় বোঝানো কখনোই সহজ না। যেমন ধরুন একজন সাধারণ মানুষকে আপনি একটা সুন্দর বিল্ডিং যে সুন্দর সেটা বোঝাতে পারবেন। কিন্তু স্ট্রাকচারালি কেন সেটি দুর্বল তা বোঝাতে পারবেন না। এজন্য তার স্ট্রাকচারের পূর্ণ জ্ঞান রাখা লাগবে।

আমার ব্যক্তিগত অবজারভেশন আমি এখানে বলবো।

আমি দশ বছর আগের তাবলীগের কথা বলছি। এখন কী করে ঠিক বলতে পারবো না। হয়তো অনেক কিছু চেঞ্জ হয়েছে, হয়তো হয়নি। আগেই বলে রাখি আমি বাইরে থেকে দেখে বলছি না, নিজেও এই জামাতের সদস্য — তিন চিল্লার কোর্স করা।

< >

প্রথমেই এদের ভালো দিকগুলো বলি। পৃথিবীর সম্ভবত অর্ধেক মুখলেস মানুষ এই জামাতে বিরাজমান। যারা নিজের খেয়ে নিজের পরে মানুষের জন্য সময় ব্যয় করে। নির্মোহভাবে। কেবল নিজের নাজাতের জন্য। অন্যান্য দশটা মানুষ থেকে আমলের ব্যাপারে অধিক অগ্রসর।

যিকির, ফিকির, আনুগত্য, নেতৃত্ব, ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য অসম্ভব সুন্দর।

এদের ব্যাপারে যে অভিযোগ করা হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় তাদের দাওয়াতি সিস্টেম আর অজ্ঞতা নিয়ে। দাওয়াতি সিস্টেম বা চিল্লার প্রক্রিয়া নিয়ে আসলে কথা বলা যায় না। কারন ওটা একটা কোর্স মাত্র। যেমন আমরা দুই বছর, চার বছরের কোর্স করি। এটা একটা ক্যাম্পিং, আর সবার সিস্টেমেই কিছু নিজস্ব নিয়ম আছে। এটা খারাপ কিছু নয়, যতক্ষণ না এই সিস্টেমকেই ইবাদত বলা হচ্ছে। আর তেমনটি কেউ দাবীও করে না।

দ্বিতীয় হলো অজ্ঞতা। আসলে এখানে যারা দাওয়াতি কাজ করে তাদের মধ্যেকার বড় অংশই দ্বীন মানার প্র্যাক্টিসের জন্য বের হয় কেবল। দ্বীন শেখানোর জন্য না, বরং মৌলিক কিছু জ্ঞান শেখা আর আমল চর্চার জন্য। খুব কম সংখ্যক — ধরুন বিশ জনের জামাতে দুই একজন আলিম হয়তো। বেশি হলে তিনজন। তবে যারা দীর্ঘদিন সময় দিয়েছে তারাই মোটামুটি তাদের লাইনে ভালো শিক্ষক। তো দ্বীনের সার্বিক আচরণে অজ্ঞতা কিছুতো থাকবেই।

কথা উঠতে পারে অজ্ঞ হয়ে আবার দাওয়াত কেন দেবে। সেটা ঠিক, তবে খেয়াল রাখতে হবে তারা কেবল শিখিয়ে দেওয়া কথাই বলে। ব্যতিক্রম খুব কম। তাদের কথা বা আলোচনা মূলত ছয়টি বিষয় নিয়ে। এগুলোর বাইরে খুব একটা যায় না। এগুলো খুবই মৌলিক। ঈমান আনো, নামায পড়ো, দ্বীনি ফরজিয়াতের জ্ঞান অর্জন করো, যিকির ফিকিরে থাকো, নিয়ত সহীহ করো, মুসলমানদের সাহায্য সম্মান করো, আর তাবলীগ করো। এখানে জটিল আলোচনা না করেও চালিয়ে নেওয়া যায়।

< >

এবার বলি আমার দৃষ্টিতে সীমাবদ্ধতা। আগেই বলেছি এটা বোঝা সবার কাজ না। আপনি কুরআন হাদিস ফিকহ ইতিহাস নিবিড়ভাবে চর্চা না করলে বিষয়গুলো ধরতে পারবেন না। তবে যা বলছি সব আমার মতে। আল্লাহই ভালো জানেন।

প্রথমত, দাঈ হিসেবে জ্ঞানগত ও মুয়ামালাতগত যে যোগ্যতা তাদের থাকা উচিৎ তা শতকরা আশিভাগেরই নেই। এটা অর্জন করার জন্য বৃহত্তর চেষ্টাও চোখে পড়ে না। নবীওয়ালা কাজ এত সহজ নয় যত সহজে তারা বোঝে। নবীওয়ালা কাজ করতে মিনিমাম তিনটা সিফতের দরকার: জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সাহস। তাদের অধিকাংশের উচিত নিজেকে আপগ্রেড করা। তুষ্ট হয়ে নিজেকে আবদ্ধ না করা। সামগ্রিকভাবে দ্বীনকে জানা আর মানা। চ্যালেঞ্জগুলো এভয়েড না করে গ্রহণ করতে শেখা। কুরআন হাদিসের মিসকোট না করা। সীরাত, ইতিহাস, তাফসির বেশি করে অনুধাবন করা।

দ্বিতীয়ত, তাদের কিতাবাদীতে যে সমস্যাগুলো বিজ্ঞ ওলামাদের অনেকে আইডেন্টিফাই করেছেন সেগুলো নিয়ে বসা উচিত। ওগুলোতো উৎসাহ বা ভয়ের জন্য। মৌলিক কিছু নয়। কেন সেগুলো রেখে অযথা বিতর্ক করা হবে?

দ্বীনের যে গ্রস মূল্যবোধের বিষয় আছে সেটারও ডেভেলপমেন্ট তাদের করা দরকার। নিজের আকাবিরদেরই কেবল নয়, বরং সকলের কথা মন দিয়ে শোনা দরকার। তাহলে ম্যাচুরিটি আসবে। সবাই যদি নিজ নিজ আকাবিরের উপর ভরসা করে বসে থাকি তাহলে তো কেউ কাউকে নসীহা করতে পারবে না। যে যেখানে শক্তিশালী সে সেখানে অন্যকে নিষিদ্ধ করেই শান্তি অনুভব করবে। কিন্তু এটাতো দ্বীনের চাহিদা নয়।

আল্লাহ আমাদের জন্য সহজ করুন। এখানে আমি আমার নিজের কথা বলেছি। কারও কিছু নিতে হবে এমন না। আল্লাহ আমাদের সত্যিকারের ভালো পথ দেখান। আমীন, ইয়া রব্বাল আলামিন।

1 comments

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান