সুস্থ পারিবারিক সম্পর্ক রক্ষায় তৃতীয় পক্ষের পরিবর্তে সরাসরি যোগাযোগই অধিকতর সহায়ক

লিখেছেন: কাজী দিশা

আমি বললে বুঝবে না, ওরে দিয়ে বলাই।

না বাবা, আমার ভয় লাগে ওর যা মেজাজ। ওরে দিয়ে বলাই।

আমি ওর সাথে সরাসরি কথা বলতে পারবো না, ও আমার কথা পাত্তাই দেয় না। ওরে দিয়ে বলাই, তাহলে শুনতেও পারে।

প্রত্যেক পরিবারে বাবা, মা, ভাই বোন এই সম্পর্কগুলোর মধ্যে একজন কিংবা একাধিক “ও” থাকে। এই “ও” পরিবারের কেউ হতে পারে, আত্মীয় হতে পারে, প্রতিবেশি কিংবা বন্ধু হতে পারে।

ফ্যামিলি ফ্রেন্ড, শুভাকাঙ্ক্ষী, প্রতিবেশি এই শব্দগুলো শুনলেই খুব কাছের মানুষ মনে হয়। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে যে ফ্যামিলি ফ্রেন্ড, শুভাকাঙ্ক্ষী সে আদতে আপনার জন্য উপকারী নাও হতে পারে।

দেখা যায় কোনো পরিবারে যেকোনো সমস্যা বা সম্পর্কের দূরত্বের ক্ষেত্রে মেসেঞ্জার, পরামর্শকের ভূমিকায় থাকে ফ্যামিলি ফ্রেন্ড, বিশ্বস্ত প্রতিবেশি এরা।

এখন কথা হচ্ছে এরা যদি দুজন মানুষকে একে অপরের সাথে সহজ হতে শেখাতে না পারে, একে অপরের সাথে সরাসরি যোগাযোগে উৎসাহী করতে না পারে তবে এই মানুষগুলো কি কাজের? দুজন মানুষের সম্পর্কের মাঝে সবসময়ই কেন তৃতীয় কাউকে দরকার?

এই মানুষগুলো গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের মতো সারাজীবন দুই ভাইয়ের মধ্যে, দুই বোনের মধ্যে, ভাই ও বোনের মধ্যে, বাবা ও ছেলের মধ্যে, শাশুড়ি ও বউমার মধ্যে — এরকম সম্পর্কগুলোতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে থেকে যায়। ফলে অন্যের আশ্রয়ে বাঁচে সম্পর্ক। ভাইকে বোনের কিছু বলতে হলে সেই তৃতীয় ব্যক্তির আশ্রয় নেয়। বোনকে ভাইয়ের কিছু বলতে হলে সেও ওই তৃতীয় ব্যক্তির আশ্রয় নেয়। ভালো মন্দ অনুভূতি যাই থাকুক, দূরত্ব ঘোচাতে সরাসরি কথা বলা হয় না। রক্তের টানে সম্পর্কগুলো জুড়ে থাকে, কিন্তু যেকোনো ছোটখাটো বিষয়ে হয়ে যেতে পারে ভুল বোঝাবুঝি।

প্রত্যেক পরিবারে কিছু কাছের মানুষ থাকবে, শুভাকাঙ্ক্ষী থাকবে কিন্তু তাকে এই সম্পর্কগুলোর মাঝে জায়গা দেওয়া ঠিক না।

ঘুরেফিরে দেখা যায় পরিবারের সকল সম্পর্কে অতিরিক্ত রাগ, একরোখা, মূল্যায়ন না করা, মত প্রকাশের সুযোগ না দেওয়া, ফ্রি না থাকা — এরকম বিষয়ে সম্পর্কগুলোতে ছোট ছোট ফাঁক থাকে। সবাই একজন মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে এই ফাঁকগুলোতে সেতু তৈরি করে। ভাবে এভাবে সব ঠিক চলে।

কিন্তু কখনোই এভাবে ঠিক চলে না। শয়তান প্রতি দুজন মানুষের মধ্যে বসার জায়গা খুঁজে। সেখানে নিজেরাই যদি নিজেদের মধ্যকার সমস্যা, নিজেদের আচরণ, ব্যক্তিত্বের সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে কাজ না করা হয় তখন মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে শয়তান গেড়ে বসে।

প্রত্যেক সম্পর্কে বোঝাপড়ায় ঘাটতি থাকতে পারে। এজন্য অভিজ্ঞ কারো পরামর্শ নেওয়া উচিৎ। শুভাকাঙ্ক্ষী আপাতদৃষ্টিতে ঠিক আছে; কিন্তু বাস্তব জীবনে পারিবারিক সম্পর্কগুলোতে আত্মীয়রূপে বা প্রতিবেশিরূপে শুভাকাঙ্ক্ষীরা বাড়ি, গাড়ি, জমি দখলের লোভ না করলে সুখ সহ্য করতে না পেরে মুখে মধু অন্তরে বিষ নিয়েই শুভাকাঙ্ক্ষী, বিশ্বস্ত, কাছের মানুষ হয়ে থাকে।

এভাবেই প্রায় পরিবারে এক অদেখা দূরত্বে এই সব শুভাকাঙ্ক্ষীদের হাতের নাটাইয়ে নাচছে ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের সম্পর্ক, বোনের সাথে বোনের সম্পর্ক, ভাইয়ের সাথে বোনের সম্পর্ক, শাশুড়ির সাথে বউমার সম্পর্ক, ননদের সাথে ভাবির সম্পর্ক, চাচাতো ভাইয়ের সাথে চাচাতো ভাইয়ের সম্পর্ক, ফুপুর সাথে ভাতিজার সম্পর্ক, মামার সাথে ভাগ্নের সম্পর্ক। এমনকি দাম্পত্য সম্পর্কও এই শুভাকাঙ্ক্ষীদের হাত থেকে বাদ যায় না।

আপনার জীবনে “ও” নামক যে বা যারা আছেন তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। সব “ও” খারাপ নয়। তবে “ও” ভূমিকায় খারাপ কেউই যথেষ্ট আপনার সম্পর্কগুলোকে জাহান্নাম করে দেওয়ার জন্য।

প্রতিটি পরিবারে দরকার সচেতনতা। অনেক আপনজন থাকবে। কিন্তু কাউকে নিজের আর প্রিয়জন সে ভাই হোক, বোন হোক, স্ত্রী হোক এই সম্পর্কের মাঝে ঢুকতে দেওয়া উচিত নয়।

এছাড়াও ধর্মীয় মুল্যবোধ, নৈতিকতার চর্চা, নিজের আচরণকে শুদ্ধ করা সবমিলিয়ে সম্পর্কগুলো সুন্দর করা যায়। চেষ্টা প্রত্যেক দুজনের জন্যই। “ও” নামক তৃতীয়জনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। শুধু প্রশ্নবিদ্ধ নয়, তৃতীয় কাউকে সবসময়ের জন্য প্রয়োজনও নেই।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান