দাম্পত্যজীবনে অহেতুক সন্দেহ ও গোয়েন্দাবৃত্তি থেকে বিরত থাকুন

লিখেছেন: ওমর ফারুক ফেরদৌস

ইসলাম মানুষকে অন্যের ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করার নির্দেশ দিয়েছে। কাউকে অহেতুক সন্দেহ করতে নিষেধ করেছে। মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি করা, দোষ খুঁজে বেড়ানো, পেছনে সমালোচনা করা এ কাজগুলো ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

কুরআনের বহু আয়াত ও হাদিসে এ ধরনের সন্দেহ, গোয়েন্দাবৃত্তি ও দোষ খোঁজার অভ্যাসের কঠোর নিন্দা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন: ‘হে বিশ্বাসী! তোমরা অন্যের ব্যাপারে অধিকাংশ আন্দাজ-অনুমান থেকে দূরে থাকো। আন্দাজ-অনুমান অনেক ক্ষেত্রেই গোনাহের কাজ। তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় খুঁজে বেড়িও না এবং কারও অনুপস্থিতিতে তার নিন্দা করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে চাইবে? তোমরা তো এটাকে ঘৃণ্য মনে করো। আল্লাহকে ভয় করো; নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’ [কুরআন ৪৯:১২]

বিখ্যাত ফকিহ ও মুহাদ্দিস ইবনে হাজার হায়সামি বলেন, ‘এ আয়াতে আল্লাহ মানুষের ব্যক্তিগত ও গোপনীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং মানুষের দোষ অনুসন্ধান করতে নিষেধ করেছেন।’

এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা ও সতর্কবাণী এসেছে বহু হাদিসেও। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘সাবধান! তোমরা সন্দেহ করা থেকে বিরত থাকো। কারণ সন্দেহ করা হচ্ছে সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার। পরস্পরের বিরুদ্ধে তথ্য তালাশ করো না এবং গোয়েন্দাগিরি করো না।’ (বোখারি : ৪৯১৭)।

আরেকটি হাদিসে এ কাজগুলো যারা করে তাদের সতর্ক করা হয়েছে। এরকম অভ্যাসের কারণে দুনিয়াতেই লাঞ্ছিত হতে হবে বলে কঠোরভাবে সাবধান করা হয়েছে। আবু বারযাহ আসলামি (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যারা মুখে ঈমান এনেছে এবং যাদের হৃদয়ে ঈমান স্থান পায়নি তারা শোন! তোমরা মুসলমানদের গিবত করো না এবং তাদের দোষ খুঁজে বেড়িও না। যে ব্যক্তি তাদের দোষ খুঁজবে আল্লাহ তার দোষ ধরবেন, আর আল্লাহ যার দোষ ধরবেন তাকে তার ঘরের ভেতরেও লাঞ্ছিত করবেন।’ (সুনান আবু দাউদ : ৪৮৮২)।

এ আয়াত ও হাদিসগুলো থেকে বোঝা যায়, প্রত্যেক মুসলমানের ব্যাপারেই ভালো ধারণা রাখা কর্তব্য। উপযুক্ত কারণ ও প্রমাণ ছাড়া অহেতুক কাউকে সন্দেহ করা অন্যায়। কারও ব্যাপারে অমূলক খারাপ ধারণা করা এবং কারও দোষ অনুসন্ধান করা গোনাহের কাজ।

স্বামী-স্ত্রী পরস্পরে ধারণা ও আচরণের ক্ষেত্রে এটা সবিশেষ প্রযোজ্য। সাম্প্রতিককালে অনেক দম্পতির মধ্যে সম্পর্কের শুরু থেকেই পরস্পরকে অবিশ্বাস ও সন্দেহ করার প্রবণতা দেখা যায়। পরস্পরের ওপর গোয়েন্দাবৃত্তিকে পরস্পরের অধিকার ও স্বাভাবিক বিষয় মনে করা হয়। ফলে অনেক সময়ই ছোটখাটো কারণে অথবা কোনো কারণ ছাড়াই তাদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি হয়। ছোটখাটো বিষয় বড় হয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্ত ঘটে যায়।

বর্তমানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, ফেইসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যম ব্যবহার করে। অনেকেই সঙ্গী বা সঙ্গিণীর অগোচরে তাদের মোবাইল ফোন চেক করেন, ফেইসবুকসহ অন্যান্য মেসেজ-অ্যাপগুলোর ইনবক্স চেক করেন। এটাকে তেমন দোষের কিছু মনে করেন না। এ ধরনের গোয়েন্দাবৃত্তি ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ওপরে বর্ণিত আয়াত ও হাদিসগুলোর নিষেধাজ্ঞা এক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

এছাড়া রাসুল (সা.) বিশেষভাবে স্ত্রীর দোষ অনুসন্ধান করতে ও তার ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে নিষেধ করেছেন। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘নবী (সা.) সফর থেকে এসে রাতে ঘরে ফেরা অপছন্দ করতেন।’ (বোখারি : ৪৮১২) আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি সফরের পর নিজের শহরে ফেরে, তখন রাতের অপ্রত্যাশিত আগন্তুকের মতো ঘরে গিয়ে উপস্থিত হতে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিষেধ করেছেন।’

সহিহ মুসলিমের আরেকটি বর্ণনায় এ নিষেধাজ্ঞার কারণও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। জাবির (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) সফর থেকে ফিরে স্ত্রীর প্রতি সন্দেহবশত বা তার ওপর গোয়েন্দাগিরির উদ্দেশ্যে রাতের বেলা অতর্কিতে ঘরে গিয়ে উপস্থিত হতে নিষেধ করেছেন।’ (মুসলিম : ৪৮১৬)।

নবীজি (সা.) সফর থেকে ফিরে সরাসরি বাসায় না ঢুকে আগে মসজিদে যেতেন। সেখানে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে তারপর ঘরে আসতেন। এতে করে ঘরের লোকেরা তাঁকে রিসিভ করার জন্য মানসিক প্রস্তুতির সুযোগ পেতেন।

এসব হাদিস থেকে বোঝা যায়, এ ধরনের সন্দেহ ও গোয়েন্দাবৃত্তি ইসলামে কতটা অপছন্দনীয়। ইসলামের নির্দেশনা হলো, যতক্ষণ পর্যন্ত স্বামী বা স্ত্রী সন্দেহজনক কিছু না করছে, ততক্ষণ পরস্পরের ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করতে হবে। প্রকাশ্য কথা ও আচরণ অনুযায়ীই পরস্পরের সঙ্গে সদ্ব্যবহার ও সদাচরণ করতে হবে। গোপনীয় বিষয় আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তাহলে আল্লাহ তাদের বৈবাহিক সম্পর্কে বরকত দান করবেন, পরিবারে শান্তি ও ভালোবাসা দান করবেন, প্রত্যেককেই বিশ্বস্ত থাকতে সাহায্য করবেন।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান