ধর্মীয় বিষয়ে ভিন্ন মতের অনুসারী হয়েও ঐক্যবদ্ধ থাকতে উভয় পক্ষের করণীয়

লিখেছেন: ড. আহমদ আলী

ক. শারঈ দলীলনির্ভর দেশের প্রচলনের ওপর আমল

শারঈ দলীলনির্ভর দেশের প্রচলনের বাইরে ভিন্নরূপ আমল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা মোটেরওপর কাম্য নয়।

‘তুলনামূলক ফিকহ’-এর একজন নগণ্য ছাত্র হিসেবে বিভিন্ন বিষয়ে আমার নিজস্ব কিছু চিন্তা ও অভিমত রয়েছে; কিন্তু আমি হানাফী মাযহাবের একজন একান্ত অনুবর্তী হিসেবে আমলের ক্ষেত্রে দেশের প্রচলনের প্রতি সম্মানপ্রদর্শন করত বরাবরই হানাফী মাযহাবের মতামত অনুসরণ করে থাকি। এ জন্য অনেকেই আমার সমালোচনাও করে থাকেন।

উল্লেখ্য, আমাদের সলফ ও ইমামগণ শরঈ সিদ্ধান্ত বর্ণনার ক্ষেত্রে যথাসাধ্য দেশে শরঈ দলীলনির্ভর প্রচলিত রীতির প্রতি নজর রাখতেন। তাঁরা সাধারণত দেশে কোনো মুজতাহিদ ইমামের মতানুযায়ী প্রচলন লাভ করেছে-এরূপ কোনো রীতির পরিপন্থী ফাতওয়া প্রচার করে এবং সে আলোকে আমলের জন্য লোকদেরকে উৎসাহিত করে উম্মতের মধ্যে কোনোরূপ বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে কিংবা তাদেরকে বিভক্ত করতে চাইতেন না।

একবার হুমাইদ রাহ. খলীফা উমার ইবনু আবদিল আযীয রাহ.-এর নিকট ফকীহদের মতপার্থক্য দূর করে সকলকে অভিন্ন মতের ওপর একত্র করতে আরয করলেন। তিনি জবাব দেন, “সাহাবীগণের মধ্যে মোটেরওপর মতপার্থক্য না থাকা আমার কাছে আনন্দের বিষয় নয়।” এরপর তিনি বিভিন্ন দেশে এ মর্মে নির্দেশ লিখে পাঠান, প্রত্যেক কওমই যেন নিজ নিজ দেশের ফকীহগণের মতের ভিত্তিতে ফায়সালা পেশ করেন। (দারিমী)

খলীফা হারুনুর রশীদ উম্মতের বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে সকলকে মুওয়াত্তার ওপর একমত করতে চেয়েছিলেন, তখন ইমাম মালিক রাহ. তাঁকে এরূপ কাজ করতে বাধা দেন এবং বলেন, “রাসূল সা.-এর সাহাবীগণ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে গেছেন এবং তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁর নিকট থেকে যা শুনেছেন তা-ই বর্ণনা করেছেন। আর প্রত্যেক দেশের আমল সেই অবস্থার ওপরই স্থিতিশীলতা লাভ করেছে, যা রাসূল সা.-এর নিকট থেকে তাঁদের কাছে পৌঁছেছে। কাজেই আপনি লোকদেরকে তাদের স্ব স্ব অবস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য করবেন না।”

এখানে লক্ষ্য করার ব্যাপার হলো, ইমাম মালিক (রাহ.)-এর সাথে অনেক বিষয়ে অন্যান্য ইমামের মতানৈক্য রয়েছে; কিন্তু খলীফা যখন তাঁর মাযহাবটি রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বত্র চালু করতে ইচ্ছা পোষণ করলেন, তখন তিনি তাতে সম্মত হলেন না; বরং তিনি লোকদেরকে তাদের স্ব স্ব অবস্থানের ওপর বহাল রাখতে নির্দেশ দিলেন।

খ. বিরোধী মতের ওপর আমলকারীর প্রতি উদারতা

শারঈ দলীলনির্ভর দেশের প্রচলনের বাইরে ভিন্নরূপ আমল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা যেমন কাম্য নয়, তেমনি ইমামগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে-এরূপ মতবিরোধপূর্ণ গবেষণাধর্মী বিষয়সমূহে কোনো আমলকে মোটেরওপর অস্বীকার করাও বাঞ্ছনীয় নয়।

ইসলামী আইনের একটি প্রসিদ্ধ সূত্র হলো-

لا ينكر المختلف فيه وإنما ينكر المجمع عليه

‘‘(সহীহ বা নির্ভরযোগ্য দলীলের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা) মুখতালাফ ফীহ’ [বিরোধপূর্ণ] বিষয়গুলো (মোটেরওপর) অস্বীকার করা যাবে না। কেবল সর্বসম্মত (-ভাবে অন্যায্য বা অপ্রমাণিত) বিষয় হলেই তা অস্বীকার করা যাবে।”

কাজেই যদি ব্যক্তিবিশেষকে কোথাও দেশের প্রচলনের বাইরে অন্য কোনো ইমামের মতানুসারে আমল করতে দেখা যায়, এজন্য তাকে দোষারোপ করা যাবে না, তাকে তিরস্কার করা যাবে না। এরূপ আচরণ বাড়াবাড়ি ও পক্ষপাতদুষ্টতা হিসেবে বিবেচিত হবে।

মুজতাহিদ ইমামগণ যদিও বিভিন্ন বিষয়ে নিজস্ব চিন্তা ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে মতপার্থক্য করেছেন; কিন্তু তাঁরা কখনো তাঁদের মতের ভিন্নরূপ আমলকারীকে খারাপ জানতেন না।

আমীরুল মু’মিনীন ফিল হাদীস সুফ্ইয়ান আস-সাওরী [৯৭-১৬১ হি.] (রাহ.) বলেন,

إذا رأيت الرجل يعمل العمل الذي قداختلف فيه، وأنت ترى غيره فلا تنهه.

“মতপার্থক্যপূর্ণ ক্ষেত্রে কাউকে তোমার মতের বিপরীত আমল করতে দেখলে তাকে বাধা দিয়ো না।”

তিনি আরো বলেন,

ما اختلف فيه الفقهاء، فلا أنهى أحدا من إخواني أن يأخذ به.

“ফকীহদের মতবিরোধ রয়েছে- এমন ক্ষেত্রে কোনো ভাইকে আমি যে কোনো মত গ্রহণে বাধা দেই না।”

সুফ্ইয়ান আস-সাওরী (রাহ.)-এর উপর্যুক্ত দুটি মন্তব্য থেকে তাঁর এ কর্মনীতি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেছে যে, তিনি নিজে একজন উঁচু মাপের মুজতাহিদ হওয়া সত্ত্বেও অন্যান্য মুজতাহিদের মতকে না-হক মনে করতেন না। তদুপরি তাঁর ‘ভাই’ শব্দটি এখানে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এতে আমাদের জন্য শিক্ষা লাভের বহু উপকরণ নিহিত রয়েছে।

ইমাম আবূ হামিদ আল-গাযালী [৪৫০-৫০৫ হি.] (রাহ.) বলেন,

“(অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানোর ক্ষেত্রে) চতুর্থ শর্ত হলো, কাজটি সর্বজন পরিচিত মন্দ কাজ হতে হবে এবং এর মন্দ হওয়াটা ইজতিহাদনির্ভর হবে না। কাজেই যে কোনো কাজে মন্দ হওয়াটা ইজতিহাদনির্ভর হলে তাতে বাধা দেওয়া যাবে না।

যেমন, কোনো হানাফী মতাবলম্বী ব্যক্তির এ অধিকার নেই যে, সে কোনো শাফি‘য়ী মতাবলম্বীকে গুঁই সাপ, হায়েনা ও বিসমিল্লাহ ব্যতীত জবাইকৃত পশুর গোশত খাওয়ার ব্যাপারে বাধা দেবে। (কেননা এগুলো হানাফী মাযহাবে জায়িয না হলেও শাফি‘য়ী মাযহাব মতে জায়িয।)

অনুরূপভাবে শাফি‘য়ী মতাবলম্বী ব্যক্তির এ অধিকার নেই যে, সে কোনো হানাফী মতাবলম্বীকে নেশা উদ্রেক করে না-এরূপ নবীয পান করার ব্যাপারে বাধা দেবে। (কেননা নবীয শাফি‘য়ী মাযহাবে জায়িয না হলেও হানাফী মাযহাব মতে জায়িয।)….”

বিজ্ঞ ইমামগণের উপর্যুক্ত বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, অন্যায় কাজের প্রতিবাদের ক্ষেত্রে প্রতিবাদকারীকে অবশ্যই এ কথা জানতে হবে, তিনি যে বিষয় থেকে লোকদেরকে বারণ করছেন, তা নিঃসন্দেহে ইমামগণের নিকট সর্বসম্মতভাবে হারাম বা মাকরূহ।

ইমামগণ যেসব বিষয়ে হালাল-হারাম কিংবা জায়িয-নাজায়িয হবার ব্যাপারে মতানৈক্য করেছেন, সেসব বিরোধপূর্ণ বিষয়ে কাউকে নিজের মাযহাবের পরিপন্থী কাজ করতে দেখলে তাকে বাধা প্রদান করা সমীচীন নয়।

যেমন- ধরুন, আপনি মসজিদে নববীতে বসে দীনী ইলম চর্চা করছেন। এ সময় আপনি দেখতে পেলেন যে, জনৈক ব্যক্তি সালাতুল ‘আসরের পরে মসজিদে প্রবেশ করে নামায পড়ছেন। আর আপনি মনে করেন যে, সালাতুল ‘আসরের পর কোনো নামায নেই। এ অবস্থায় যদি আপনি লোকটিকে কার্যত বাধা দিতে চান, তাহলে আপনাকে জানতে হবে যে, এ বিষয়ে সকল ইমামের মত কী? যদি আপনি জানতে পারেন যে, ইমাম শাফি‘য়ী (রাহ.)-এর মতে, সালাতুল আসরের পর নামায পড়া জায়িয, তাহলে আপনার জন্য নামাযরত লোকটিকে বাধা প্রদান করা সমীচীন হবে না। কেননা, সে তো এ কথা বলতে পারে যে, কী কারণে আমি নামায পড়বো না?! হয়তো তখন আপনি বলবেন যে, তিনজন ইমামের মতে- এ সময় কোনো নামায নেই। আপনার এ কথা শুনে লোকটি আপনাকে বলতে পারে যে, আমি তো শাফি‘য়ী মতাবলম্বী। তাঁর মতে, সালাতুল ‘আসরের পরেও নামায পড়া যায়। আর তোমাদের মাযহাবগুলো আমার মাযহাবের চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়। তখন হয়তো আপনি তাকে এতদসংক্রান্ত হাদীসটি বলবেন। কিন্তু সেও আপনাকে বলতে পারে যে, এ সম্পর্কে অপর একটি হাদীস রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে,

إذا دخل أحدكم المسجد فلا يجلس حتى يصلي.

“যখন তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করবে, সে যেন নামায পড়া ব্যতীত বসে না যায়।”

এভাবে আপনি হয়তো এমন এক ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে যাবেন, যা বাঞ্ছনীয় নয়।

বর্ণিত আছে, একবার ইমাম মালিক (রাহ.) আসরের নামাযের পর মসজিদে নবভীতে প্রবেশ করলেন এবং তিনি তাঁর মতানুসারে তাহিয়্যাতুল মসজিদের দু রাক‘আত নামায না পড়েই বসে গেলেন।

এ সময় একজন বালক তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “শাইখ! ওঠে দু রাক‘আত নামায আদায় করুন!” তিনি তৎক্ষণাৎ ওঠেই দু রাক‘আত নামায আদায় করলেন। তখন তাঁকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জবাব দেন,

خشيت أن يصدق قوله تعالى :وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ ارْكَعُوا لَا يَرْكَعُونَ

‘‘আমি আশঙ্কা বোধ করলাম যে, আল্লাহ তাআলার বাণী ‘‘এ জালিমদের অবস্থা হচ্ছে, যখন তাদেরকে বলা হয় যে, তোমরা আল্লাহ তাআলার দরবারে রুকূ-অবনত হও, তখন তারা রুকূ-অবনত হয় না।’’(আল-কুরআন, ৭৭:৪৮) হয়তো আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।”

লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, ইমাম মালিক রাহ.-এর মতো একজন ইমাম কেবল একজন বালকের কথায় তার নিজের অভিমতের ওপর অনড় থাকেননি; বালকের সাথে কোনোরূপ দ্বন্দ্বে না জড়িয়ে তার কথা মতো আমল করলেন।

গ. আবেগের প্রতি সম্মান প্রদর্শন

শরী‘আতের সীমার মধ্যে হলে অর্থাৎ বিশুদ্ধ কোনো একটি দলীলও যদি পাওয়া যায়, তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় মানুষের আবেগের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাও কাম্য, যদিও তা নিজের অভিমত কিংবা নিজের মাযহাবের রায়ের বিরোধী হয়।

হানাফী মতাবলম্বী বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও ফকীহ বাদরুদ্দীন আল আইনী রাহ. ইমাম আবূ হানীফা রাহ.-এর জানাযা সম্পর্কে লিখেন,

‘‘তাঁর জানাযায় উপস্থিত লোকদের প্রচুর ভীড়ের কারণে তাঁর ইন্তিকালের দিন ছয়বার জানাযা পড়া হয়। তাঁর দাফনের পর খলীফা মনসুর এসে তাঁর কবরের পাশে জানাযা পড়েন। এ কথাও প্রচলিত আছে যে, ইমাম আবু হানিফা রাহ.-কে দাফন করার পর লোকেরা বিশোধিক দিন লাগাতার তাঁর কবরের পাশে জানাযার সালাত আদায় করেন।” (মাগানিউল আখইয়ার, খ. ৫, পৃ. ১৬৫)

লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, সেই সময়কার হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফকীহগণের মধ্যে কেউ মানুষের এই আবেগের প্রতি অসম্মান করে এ বিষয়ে কোনো ফাতওয়া দিয়েছেন মর্মে কোনো তথ্য জানা যায়নি। অথচ হানাফী মাযহাব মতে- বারংবার জানাযা আদায় এবং গায়েবানা জানাযা পড়া জায়িয নয়; মাকরূহ।

ইসলামের ইতিহাসে মধ্যযুগের এমন বহু প্রখ্যাত আলিম [যেমন- ইবনু তাইমিয়াহ, ইযযুদ্দীন ইবনু আবদিস সালাম ও জালালুদ্দীন আস সুয়ূতী রাহ. প্রমুখ] সম্পর্কে জানা যায় যে, তাদের একাধিকবার জানাযা আদায় করা হয় এবং দেশে-বিদেশে তাদের গায়েবানা জানাযা পড়া হয়। এও বর্ণিত আছে যে, দেশে-বিদেশে ইবনু তাইমিয়াহ রাহ.-এর দেড় শতাধিকবার জানাযা নামায আদায় করা হয়।

অবশ্যই তাদের মাযহাব অনুসারে- একাধিকবার জানাযা আদায় ও গায়েবানা জানাযা পড়া জায়িয। তবে সেই সময়কার অন্যান্য মাযহাবের ফকীহগণের মধ্যে কেউ মানুষের এ আবেগের প্রতি অসম্মান করে এ বিষয়ে কোনো সমালোচনা করেছেন মর্মে কোনো তথ্য জানা যায়নি।

কাজেই পরিস্থিতি বিবেচনায় মানুষের আবেগের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে কোনো দোষ নেই, যদি সেই আবেগের পক্ষে কোনো না কোনো বিশুদ্ধ দলীল থাকে কিংবা কোনো মাযহাবে এর পক্ষে মত থাকে।

তবে এটা ঠিক যে, এরূপ আবেগতাড়িত কোনো আমলকে জেনরালাইজ করা বা সাধারণ রীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করাও মোটেরওপর সমীচীন নয়।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান