নবীজির ﷺ দাদা আব্দুল মুত্তালিব যেভাবে সুখ্যাতির শিখরে আরোহণ করেছিলেন

আগের লেখায় আমরা জেনেছিলাম যে, প্রিয়নবী মুহাম্মাদ(সা) এর দাদা, যাকে আমরা আব্দুল মুত্তালিব নামে সাধারণত চিনি, তার জন্মগত নাম আসলে ছিল শাইবা (সাদা চুলওয়ালা), কারণ জন্মের সময় তার মাথায় কিছু সাদা চুল ছিল। আজ আমরা জানব শাইবা কিভাবে কুরাইশদের কাছে আব্দুল মুত্তালিব হলেন, আর কিভাবেই বা তিনি আরবের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হলেন সেই সম্পর্কে।

সেদিন যেমনটি বলেছিলাম, শাইবার বাবা বিখ্যাত কুরাইশ নেতা হাশিম — যিনি রাসূলুল্লাহ(সা) এর দাদার বাবা ছিলেন — তিনি যদিও মক্কায় থাকতেন, কিন্তু ইয়াসরিবের সম্ভ্রান্ত বনু নাজ্জার গোত্রের সালমাকে বিয়ে করে সিরিয়ায় বাণিজ্য সফর করতে যেয়ে পথে মারা যান। উল্লেখ্য, পরবর্তীতে এই ইয়াসরিবেরই নাম হয়েছে মদীনা। শাইবা বড় হতে থাকেন ইয়াসরিবেই, তার মায়ের কাছে। এমনকি মক্কার কেউ ভালোমতো জানতও না যে হাশিম ইয়াসরিবে বিয়ে করেছিলেন।

হাশিম মারা যাওয়ার পর মক্কায় হাজিদের খাবার-পানির ব্যবস্থা করার ও আতিথেয়তার দায়িত্ব পেয়েছিলেন তার ভাই আল-মুত্তালিব। এই আল-মুত্তালিব খুব ভালো মানুষ ছিলেন। হাজিদের সেবা করতে যেয়ে থেকে থেকে ভাইয়ের কথা মনে পড়ত তার। আল-মুত্তালিবকে হঠাৎ একজন একদিন খবর দিল – ইয়াসরিবে তোমার ভাই হাশিমের তো এক স্ত্রী আর সন্তান আছে! খবর শুনে আর বসে থাকতে পারলেন না আল-মুত্তালিব। চলে গেলেন ইয়াসরিবে। সেখানে গিয়ে তিনি হাশিমের স্ত্রী-সন্তানকে খুঁজে বের করলেন।

শাইবার তখন বালক বয়স। বাচ্চা শাইবাকে দেখেই তার মধ্যে নিজের ভাইয়ের ছায়া দেখতে পেলেন আল-মুত্তালিব। শাইবার মা’কে বললেন – “শাইবা আমাদের বংশ, আমাদের রক্ত, ওকে আমি মক্কায় নিয়ে যাব।“ শাইবার মা প্রথমে কিছুতেই রাজী হলেন না। আল-মুত্তালিব জোরাজুরি শুরু করলেন। তিনি বলতে লাগলেন – মক্কায় এত বড় সম্মানের অধিকারী ছিল হাশিম, এত বড় ব্যবসায়ী ছিল, কুরাইশ বংশের শ্রেষ্ঠ পরিবারে তার জন্ম – সে কেন তার বাপের ভিটায় ফিরে যাবে না? তার বাবা মক্কায় হাজীরা আসলে তাদের দেখভাল করত, খাওয়াদাওয়া করাত – এই গৌরবের কাজ কেন তার ছেলে করবে না? এরকম অনেক কিছু বলার পর সালমার হাত থেকে শাইবাকে নিতে পারলেন আল-মুত্তালিব। কিন্তু, আল-মুত্তালিব যখন শাইবাকে নিয়ে মক্কায় ঢুকলেন, তখন মক্কার সবাই প্রথমে মনে করল এই বাচ্চা মনে হয় আল-মুত্তালিবের নতুন দাস। তিনি হয়ত এই সফরে এই দাসকে কিনে নিয়ে এসেছেন। এর জন্য লোকে শাইবাকে আব্দুল মুত্তালিব (অর্থাৎ, মুত্তালিবের দাস) নামে ডাকা শুরু করল। আর এই নামটাই তার সাথে রয়ে গেল। এই নামেই তিনি পরিচিতি পেলেন।

আল-মুত্তালিব খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। ভাতিজা আব্দুল মুত্তালিবকে ধীরে ধীরে হাজিদের কিভাবে আপ্যায়ন করতে হয়, কিভাবে তাদের খাবার-পানির ব্যবস্থা করতে হয় সব তিনি শিখিয়ে দিলেন। হাশিমের আরেক ভাই নওফেল ব্যাপারটাকে প্রথম থেকেই বাঁকা চোখে দেখত। কিন্তু, আল-মুত্তালিবের জন্য কিছু বলতে পারত না। আল-মুত্তালিব তার ভাতিজা আব্দুল মুত্তালিবকে তাই ভাইয়ের সব সম্পত্তিতে অংশও দিয়ে দিলেন। হাশিম যেহেতু অনেক ধনী ছিলেন, কাজেই আব্দুল মুত্তালিব হঠাৎ করেই উত্তারাধিকার সূত্রে অনেক ধনী হয়ে গেলেন। সেই ধন বিনা দ্বিধায় হাজিদের মধ্যে আর গরীবদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করলেন আব্দুল মুত্তালিব। দানশীলতা ও সততার জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠলেন তিনি।

সব ভালোই যাচ্ছিল। ঝামেলা বাধল যখন চাচা আল-মুত্তালিব মারা গেলেন। আল-মুত্তালিবের ভাই নওফেল আগে থেকেই আব্দুল মুত্তালিবের এত জনপ্রিয়তা ও এত টাকা-পয়সা সহ্য করতে পারত না। আল-মুত্তালিবের মৃত্যুর পর সে তার গুন্ডাপান্ডা নিয়ে আব্দুল-মুত্তালিবের কিছু জমিজমা দখল করা শুরু করল। আব্দুল মুত্তালিব কুরাইশের বিভিন্ন গোত্রের কাছে সাহায্য চাইলে কেউ এগিয়ে আসার সাহস করল না। আব্দুল মুত্তালিব তখন ইয়াসরিবে তার মামা আবু আসাদ বিন আদি-কে খবর পাঠালেন। আবু আসাদ বনু নাজ্জার গোত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি তার দলবল নিয়ে এসে নওফেলকে কঠিন করে শাসালেন। নওফেলের দলে ছিল হিশামের আরেক ভাই আব্দুশ-শামস। অন্যদিকে মক্কার বনু খুজা’আ গোত্র আব্দুল মুত্তালিব ও আবু আসাদের পক্ষ নিল। নওফেল দখলকৃত জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। কিন্তু, মনে মনে হিংসা পুষে রাখল। এই হিংসার আগুন যুগের পর যুগ চলবে – যা আমরা অনেক পরে দেখতে পাব।

এদিকে আব্দুল মুত্তালিবের দানশীলতা আর জনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকল। শুধু হাজি বা অভুক্ত মানুষ নয়, মক্কার পাখিদেরকে পর্যন্ত খাবার দিতেন আব্দুল মুত্তালিব। বলা হয়ে থাকে – আব্দুল মুত্তালিব কখনো কোনো বাজে কাজে জড়াতেন না, মূর্তির নামে জবাই করা মাংস খেতেন না। মানুষ বিপদে পড়লে তার কাছে এসে দু’আ চাইত, দু’আ কবুল হতো। অনেকে এ সময় তাকে শাইবাতুল হামদ (প্রশংসিত সাদা-চুল) নামে ডাকা শুরু করল।

/// প্রাসঙ্গিক লেখা: নবীজির পিতৃপুরুষ প্রতিমা পূজারি ছিলেন? ///

আগেই বলেছি, আব্দুল মুত্তালিবকে আরবের অবিসংবাদিত নেতা বলা হয়। কুরাইশ বংশের মান তিনি ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা তো জানলাম তিনি প্রচন্ড দানশীল ও দয়ালু ছিলেন। কিন্তু শুধু কি এটুকই? না। আব্দুল মুত্তালিবের আরবের অবিসংবাদিত নেতা হওয়ার পেছনে তিনটি মূল ঘটনা ছিল, যার মাধ্যমে আল্লাহ তাকে সম্মানিত করেছিলেন। এই তিনটি ঘটনা হলো — (১) যমযম কূপ খুঁজে পাওয়ার ঘটনা, (২) আব্দুল্লাহর কুরবানীর ঘটনা, আর (৩) আবরাহা ও হাতির ঘটনা। আমরা এই তিনটি ঘটনা সম্পর্কেই জানব। যমযম কূপ খুঁজে পাওয়ার ঘটনা দিয়ে শুরু করব – তবে সেটা বলব পরের পর্বে।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান