খ্রিস্টীয় মতবাদের বলে বলীয়ান হয়ে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল যেভাবে অস্তিত্বে এল

নবী ইয়াকুব (আ.)-এর নাম ছিলো ইসরাইল বা আল্লাহর বান্দা। তাঁর বারো ছেলে ও তাঁদের বংশধরেরা হলেন বনী ইসরাইল। মহান আল্লাহ অন্যান্য জাতির উপরে তাদের অনেক ফজিলত দিয়েছেন [দেখুন: কুরআন ২:৪৭ , ৪৫:১৬]। তাদের স্থানকে বরকতময় করেছেন [দেখুন: কুরআন ২১:৭১, ৫:২১]। অনেক নবী করেছেন তাদের থেকে। তাদের মূল ভুমি হলো কিনান বা ফিলিস্তিন। এর মধ্যেই জেরুজালেম।

ইতিহাসের একেক সময়ে জেরুজালেম একেক জাতির অধীনে ছিলো। মুসা (আ.)-এর সময় আমালিকাদের অধীনে ছিলো। পরে ইউশা ইবনে নুনের সময় বনী ইসরাইলের দখলে আসে। এরপর সুলাইমান (আ.)-এর পরে ইরাকের ব্যাবিলন সম্রাট বুখতে নাসর ইসরাইলীদের ধ্বংস করে। আবার একটা সময় পারস্য সম্রাট সাইরাস ব্যাবিলনিয়দের পরাজিত করে বনী ইসরাইলকে জেরুজালেমে নিয়ে আসেন। একসময় রোমান সম্রাট টিটাস তাদের জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত করে। শেষে উমার (রা.)-এর সময়ে মুসলমানদের অধীনে আসে পবিত্র ভূমি জেরুজালেম।

১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে জেরুজালেম ছিলো উসমানী খিলাফতের অধীনে। এই যুদ্ধে পরাজয়ের পরে জেরুজালেম উসমানীদের হাতছাড়া হয়ে যায়, চলে যায় ব্রিটিশদের কাছে। ব্রিটিশরা ইহুদিদের হাদিয়াস্বরূপ জেরুজালেম দান করে। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল জয় লাভ করে। এরপর থেকে ইসরায়েল রাষ্ট্র চলছে।

এদিকে, পবিত্র ভূমি জেরুজালেমের সাথে মুসলিমদের সম্পর্কও অনেক গভীর। বনী ইসরাইলের অধিকাংশ নবী এসেছেন এই অঞ্চলে। মহান আল্লাহ একে বরকতময় করেছেন। মুসলমানদের প্রথম কিবলাও ছিলো জেরুজালেমের বায়তুল মুকাদ্দাস। এখানে সালাত পড়লে অনেকগুন বেশি সাওয়াব। এগুলো আমরা কমবেশি জানি। কিন্তু ইহুদিরা কেন জেরুজালেমের দখল চায়? আর খ্রিস্টানরাই বা কেন ইহুদিদের জেরুজালেম দখলে সাহায্য করে? তারা নিজেরাও কি দখল চায়?

ইহুদিরা নিজেদের আল্লাহর প্রিয়তম বান্দা মনে করে। তারা মনে করে যে, শাম এলাকাটা মহান আল্লাহ তাদের লিখে দিয়েছেন। কুরআনেও এটা আছে, যদিও তা নিশর্ত নয়; শর্ত হলো তারা আল্লাহর কিতাব অনুসরণ করবে।

অর্থোডক্স ইহুদিরা ‘তাওরাতের আইন’ মেনে চলার চেষ্টা করে। এরা টুপি পরা এবং বিশাল দাঁড়িওয়ালা। তাওরাতের বিধান অনুযায়ী সব আইন পালন করার চেষ্টা করে। ঈমান, নামায, রোজা, হজ, যাকাত, শিরক, তাওহীদ, তাহারাত, পর্দা, হালাল-হারাম — সবই ওদের শরিয়তে আছে। তারা বিশ্বাস করে কিয়ামতের আগে King Messiah আসবেন। তিনি ইয়াকুব (আ.)-এর কিবলা-পাথরের উপর 3rd Temple নির্মাণ করবেন। পৃথিবী শাসন করবেন। যেমন আমরা বিশ্বাস করি ইমাম মাহদি আসবেন, ঈসা (আ) আসবেন, মুসলিমরা পুরো পৃথিবী রাজত্ব করবে — এরকম একই রকম।

তাওরাত অনুযায়ী ইহুদিরা জেরুজালেমে ফিরবে যখন তাদের মাসীহ আসবেন। এর আগে পর্যন্ত এটি তাদের জন্য হারাম। অর্থাৎ, ইহুদিদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী তারা তাদের মাসীহ না আসা পর্যন্ত ইসরায়েলে ঢুকতে পারবে না। এর আগে ওখানে রাষ্ট্র বানানো বা জড়ো হওয়াকে তারা আল্লাহর কাজে হস্তক্ষেপ বলে মনে করে। আর তারা নিজেদেরকে অপবিত্র মনে করে। ভয় করে যে, বাইতুল মাকদিসে ঢুকলে নিজের অজান্তে পবিত্র জায়গা পা দিয়ে মাড়াতে হতে পারে। এ কারণে তারা বাইতুল মাকদিসে নিজেদের ঢোকা হারাম মনে করে আর western wall (বাইতুল মাকদিসের সীমানা প্রাচীর)-এ দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করে। তাহলে প্রশ্ন আসে, বর্তমানে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল কেন জেরুজালেম দখল করতে চায়?

বর্তমান ইসরায়েল রাষ্ট্র মূলত জায়োনিস্টদের তৈরি যাদের অধিকাংশ ঐতিহাসিকভাবে সোশ্যালিস্ট, সেকুলার এবং ধর্মকর্মহীন। তারা ধর্মীয় মুল্যবোধ ও বিশ্বাসের চেয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। অনেকটা আমাদের গরু খাওয়া সেকুলার মুসলিমদের মতো, যারা ধর্মকর্মের ধার তো ধারেই না বরং ধর্মকেই রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগায়।

মূল অর্থোডক্স ইহুদি আর জায়োনিস্টরা এক নয়। জায়োনিস্টদের এজেন্ডা হলো ইহুদিদের জন্য একটা জাতি রাষ্ট্র তৈরী করা। এর অনেক কারন আছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো নিজেদের জন্য একটা শক্ত রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরী করা। কন্ট্রোলিং সেফ জোন তৈরী করা। ধর্মকর্মহীন হলেও ইহুদি জাত হওয়ার কারণে তারা কোথাও তেমন একটা সুবিধায় ছিলো না। এরপর হলোকাস্টের (হিটলারের ইহুদি নিধন) প্রভাব তো আছেই। ওদের বেশীরভাগই আসলে ইউরোপিয়ান কনভার্ট। ইহুদিরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যখন ছড়িয়ে ছিলো তখন তারা খ্রিস্টানদের সাথে মিলে ছিলো। সুতরাং তাদের নিজেদের একটা রাষ্ট্রও দরকার ছিলো। এই রাষ্ট্র কোথায় হবে তার কয়েকটা অপশন থাকলেও ভূরাজনৈতিক মর্যাদায় জেরুজালেমই ছিলো তাদের বেস্ট অপশন।

জায়োনিজম মূলত একটা খ্রিস্টীয় মতবাদ। খ্রিস্টান বাইবেল অনুযায়ী বনী ইসরাইলের বারো জাতি জেরুজালেমে এক হবার আগে পর্যন্ত ঈসা মাসীহ পুনরাগমন করবেন না। মাসীহের অপেক্ষায় অস্থির খ্রিস্টান জাতি ১৭শ-১৮শ শতকের দিকে এভাবে বাইবেল ব্যাখ্যা করা শুরু করে যে, মাসীহের আগমন ঘটানোর জন্য ইহুদিদেরকে জেরুজালেমে ঠেসে ভরতে হবে।

উসমানী খিলাফতের সময় খ্রিস্টানরা দেখলো যে, ওখানে থাকে মুসলিমরা। আর ইহুদিদের বেশীরভাগই ইউরোপে। খ্রিস্টান নেতারা ইহুদিদেরকে জেরুজালেমে যাবার জন্য ফুসলাতে লাগলো। ইউরোপীয় ইহুদিদের বেশিরভাগই খুব একটা ধার্মিক ছিলো না। তারা সেকুলার বিভিন্ন দর্শনের রাজনৈতিক মতবাদ অনুসরণ করত। এক পর্যায়ে এসে খ্রিস্টানদের ফুসলানীতে তারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। ইউরোপীয় ইহুদিদের মধ্যেও জায়োনিজম মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তারাও তাদের কিতাব সেই অনুযায়ী ব্যাখ্যা করতে শুরু করে।

এভাবে অধার্মিক ইহুদিরা তাদের কিতাবের কিছু অংশ খ্রিস্টানদের মতো ব্যাখ্যা করে ফিলিস্তিনের ইহুদি রাষ্ট্রের রূপরেখা তৈরি করে ফেলে। Theodor Herzl নামে এক ইহুদি বুদ্ধিজীবি এটা নিয়ে বিস্তারিত নীতিমালা তৈরি করে লেখালেখি শুরু করেন। এর দ্বারা ইউরোপের বেশীরভাগ ইহুদি প্রভাবিত হয়ে যায়। খ্রিস্টীয় ব্রিটেন তাদেরকে মদদ দিতে থাকে।

ইহুদি নেতারা উনবিংশ শতকের শেষ দিক থেকে আর বিংশ শতকের শুরুতে উসমানী খলিফাদের সাথে দেনদরবার শুরু করে যেন ফিলিস্তিন তাদের দিয়ে দেওয়া হয়। তারা কখনো আশা করত না যে, উসমানীদের পরাজিত করতে পারবে। ইহুদিরা সংখ্যা ও শক্তিতে একেবারেই নগন্য ছিলো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীরা হেরে গেলে ইহুদিদের সামনে ফিলিস্তিনের দরজা খুলে যায়। পুরো মধ্যপ্রাচ্য চলে গেল যুদ্ধে জয়ী মিত্রশক্তির হাতে। আর খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটেন ও আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধানেরা তাদের মাসীহ আগমন করানোর নিয়তে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অঙ্গীকার করে বসেন। এটা তাদের করতেই হতো। ধীরে ধীরে বিভিন্ন ছলাকলা করে ইসরায়েল রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলা হলো।

খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে মাসীহকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল এবং তিনদিন পর তিনি মৃত্যু থেকে পুনরুত্থিত হয়েছিলেন। এরপর শিষ্যদেরকে দিকনির্দেশনা দিয়ে আসমানে চলে গিয়েছেন। কিয়ামতের আগে তিনি আবার আসবেন। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, সবাই তখন ঈসা (আ.)-এর সামনে মাথা নত করবে ও তাঁর উপাসনা করবে। ঈসা (আ.) মানুষের বিচার করবেন। তারা ঈসা (আ.)-কে বিচার দিবসের মালিক মনে করে। তাদের বিশ্বাস, বনী ইসরাইলের বারো জাতি জেরুজালেমে এক হবার আগে পর্যন্ত মাসীহ পুনরাগমন করবেন না। মূলত এই কারণেই তারা ইহুদিদের ইসরায়েল রাষ্ট্রের সমর্থক এবং তাদের জেরুজালেম দখলে সাহায্যকারী।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান