পর্ন ও যৌনতার হাতছানিতে পরিপূর্ণ অবাধ ইন্টারনেট আপনার সন্তানের সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে

Internet and risk

দুই বোন এক চাপা আতংক নিয়ে দিন পার করছে— আশেপাশের কেউ কি তাদেরকে চিনে ফেলছে? এই ভয়ে একজন সবসময় হুডি পরে বের হয়। আরেকজন তার চুলের রং পাল্টে ফেলেছে, যেন তাকে চেনা না যায়। দুজনেই চেষ্টা করছে, তাদেরকে কেউ দেখে যেন সনাক্ত করতে না পারে ছোটবেলায় তাদের সাথে কী ঘটেছিল।

দশ বছর আগে তাদের বাবা এক বীভৎস কাজ করেছে। সে এবং তার কিছু সহযোগী পুরুষ মিলে মেয়ে দুটিকে দিনের পর দিন ড্রাগ খাইয়ে, তারপর তাদের সাথে অকল্পনীয় জঘন্য কাজ করে সেগুলোর ছবি এবং ভিডিও ইন্টারনেটে অন্যের কাছে বিক্রি করেছে।

সেই লোকগুলো এখন জেলে আছে। কিন্তু মেয়ে দুটি প্রতিদিন ভয়ে-ভয়ে পার করে। কারণ তাদের সেই জঘন্য ছবি এবং ভিডিওগুলো হাজার-হাজার মানুষ তাদের কম্পিউটার এবং মোবাইল ফোনে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এগুলো এখন ড্রপবক্স, গুগল ড্রাইভ, মাইক্রোসফট ওয়ান ড্রাইভ-এ ছড়াচ্ছে। কত পশুরূপি মানুষ সেগুলো দেখছে, তার হিসেব নেই। এদের কেউ তাদেরকে চিনে ফেললে তাদের বিরাট ক্ষতি করতে পারে। সম্মানহানি, পড়ালেখা-ক্যরিয়ার নষ্ট, ব্লাকমেইল করে অর্থ দাবি, অনৈতিক সম্পর্কে বাধ্য করা, শারীরিক আক্রমণ ইত্যাদি অনেক কিছুই তাদের সাথে ঘটে যেতে পারে। [সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস]

ইন্টারনেটে গত এক যুগে এক ভয়ংকর মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে — ছোটদের নিয়ে তৈরি পর্ন এবং তাদের উপর যৌন-নির্যাতনের ছবি এবং ভিডিও প্রচার। ১৯৯৮ সালে প্রায় তিন হাজার রিপোর্ট পাওয়া যায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে, যারা এই ধরনের জঘন্য জিনিস দেখতে পেয়ে অভিযোগ করে বিভিন্ন ওয়েবসাইট-এর কর্তৃপক্ষের কাছে।

এক যুগ পরে গিয়ে সেটা ১ লক্ষ রিপোর্টে দাঁড়ায়। এক লক্ষ রিপোর্ট! তাও আবার এই জঘন্যতম জিনিসের।

২০১৪ সালে রিপোর্ট বাড়তে বাড়তে পৌঁছায় ১০ লক্ষে। —এটা হচ্ছে শুধুই রিপোর্ট-এর সংখ্যা। কিছু ভালো মানুষেরা এগিয়ে এসে এরকম জঘন্য ছবি এবং ভিডিও রিপোর্ট করেছেন। তাহলে, রিপোর্ট হয়নি এরকম কত ছবি এবং ভিডিও ইন্টারনেটে শেয়ার হচ্ছে, সেটা চিন্তাও করা যায় না।

২০১৮ সাল ছিল এক কালো বছর। সেই বছর মোট রিপোর্ট হয়েছে ১ কোটি ৮৪ লক্ষ। সেই রিপোর্টগুলোর মধ্যে ছিল সাড়ে-চার কোটি ছোটদের-পর্ন, ছোটদের ধর্ষণের ছবি এবং ভিডিও। [সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস]

সংখ্যাটি আরেকবার পড়ুন— সাড়ে-চার কোটি ছবি এবং ভিডিও। এক বছরে।

এর মধ্যে কত লক্ষ বাচ্চা জড়িত? আজকে সারা পৃথিবীতে যে ছেলে-ধরা, শিশু-অপহরণ ব্যাপক হারে হচ্ছে, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই জঘন্য জিনিস-এর চাহিদা এবং সরবরাহ মেটানোর জন্য নিত্য-নতুন বাচ্চাদের যোগান দেওয়া।

২০১৯ সালে কত রিপোর্ট হয়েছে, সেটা ফেইসবুকের নিরাপত্তা টিমে কাজ করার সুবাদে ভেতর থেকে দেখতে পারি। এক বছরে অবস্থার উন্নতি হওয়া তো দূরের কথা, বরং কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। মানবজাতির একটা অংশ ভয়ংকর কালো অন্ধকার জগতে ডুবে যাচ্ছে। প্রতিদিন কত লক্ষ-বার মানুষ জঘন্যতম-নোংরা এইসব জিনিস শেয়ার করার চেষ্টা করে, তার চার্ট দেখলে বোঝা যায় যে, মানবজাতির একটা অংশ মানসিকভাবে ব্যাপক বিকৃত হয়ে গেছে। ফেইসবুকের প্রায় দুই শত কোটি ব্যবহারকারীর মধ্যে কী ভয়ংকর পরিমাণে অন্যায় হচ্ছে, তার পরিসংখ্যান দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকি— এত অন্যায়কারীকে কীভাবে থামানো সম্ভব?

সেই ভয়ঙ্কর মানুষগুলো আমাদের চারপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদেরকে বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এরা ভেতরে-ভেতরে এক-একটা পিশাচ। আর এই পিশাচগুলো শুধু বয়স্ক পুরুষ এবং নারীই নয়। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী বহু কিশোর-কিশোরীরাও আর মানুষ নেই, একেবারে পশু হয়ে গেছে।

সেই ১ কোটি ৮৪ লক্ষ রিপোর্টের মধ্যে মেসেঞ্জারেই রিপোর্ট হয়েছে ১ কোটি ২০ লক্ষ। মোট রিপোর্টের দুই-তৃতীয়াংশ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে মেসেঞ্জার যত নষ্টের গোঁড়া। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। মেসেঞ্জার-এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী দেখেই এত বেশি রিপোর্ট সংগ্রহ করা গেছে। আর যখন এই ধরনের জঘন্য ছবি বা ভিডিও রিপোর্ট হয়, সেটা সাথে সাথে পুরো ফেইসবুক এবং মেসেঞ্জার প্লাটফর্ম এর সব জায়গা থেকে খুঁজে বের করে স্বয়ংক্রিয় ভাবে মুছে ফেলা হয় এবং মাইক্রোসফট ও গুগলকে জানিয়ে দেওয়া হয়, যেন তারাও সেটা তাদের সব প্রডাক্ট থেকে সরিয়ে ফেলতে পারে। প্রফেসর হানি ফরিদ এক যুগ আগে এই প্রযুক্তি আবিষ্কার করেন। এটা যদি আবিষ্কার না হতো, তাহলে এতদিনে ফেইসবুক নোংরা ছবি এবং ভিডিও দিয়ে ভরে যেত। তাই, কখনো যদি খারাপ কিছু দেখতে পান, সাথে সাথে তা রিপোর্ট করুন। এভাবে আপনি ইন্টারনেট পরিষ্কারে একটা অবদান রাখবেন।

কিন্তু হোয়াটস-অ্যাপ, ইন্সটাগ্রাম, ডিস্কর্ড, টাম্বলার ইত্যাদি প্লাটফর্মগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা মেসেঞ্জার এবং ফেইসবুকের মতো নয়। যার কারণে সেইসব প্লাটফর্মে এইসব জঘন্য জিনিস আদান-প্রদান অনেক বেশি হয়, কিন্তু সেরকম রিপোর্ট হয় না। এছাড়া ফেইসবুকে বিশ হাজার লোক কাজ করে, যারা ফেইসবুক এবং মেসেঞ্জারে তথ্য মডারেশন করে। কিন্তু পৃথিবীতে এত বেশি মানুষ খারাপ হয়ে গেছে যে, তাদের সাথে পাল্লা দেওয়া অসম্ভব হয়ে গেছে।

হোয়াটস-অ্যাপ টিম একবার অনেকগুলো পাবলিক গ্রুপ এবং প্রোফাইল ছবি স্ক্যান করে মাত্র দশ দিনে ১ লক্ষ ৩০ হাজার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়, যেখানে ছোটদের-পর্ন এবং ধর্ষণের ছবি-ভিডিও আদান-প্রদান হতো। এই সংখ্যাটা আমাদেরকে দেখিয়ে দেয় হোয়াটস-অ্যাপ-এ কত কোটি নোংরা জিনিস আদান-প্রদান হচ্ছে। হোয়াটস-অ্যাপ হচ্ছে অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য। কারণ সেখানে তাদেরকে ধরা সবচেয়ে কঠিন। এর কঠিন প্রাইভেসির কারণে সেখানে নিরাপদে মেসেজ আদান-প্রদান করা যায়। আর এই নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় অপব্যবহার করে পর্ন ব্যবহারকারীরা। [সূত্র: টেকক্রাঞ্চ.কম]

অভিভাবকরা জেগে উঠুন। মাদক, রাস্তার বখাটে ছেলে, অপহরণকারীদের নিয়ে আপনারা যতটা চিন্তিত, ইন্টারনেটে সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে তার থেকে বেশি চিন্তিত হোন। ইন্টারনেটে আপনার ছেলেমেয়েরা সহজেই এমন কিছু জিনিস দেখতে পারে, যা দেখার পর সে একজন দুমুখো-শয়তান হয়ে যায়। আপনার সামনে, বাইরে মানুষের সামনে একজন ভালো, সাদাসিধে, সহজ-সরল মানুষ সেজে থাকে। কিন্তু নির্জনে ইন্টারনেটে গিয়ে পশুর থেকেও নিচে নেমে যায়।

পরিসংখ্যান অনুসারে ৯০% ছেলে এবং ৬০% মেয়ে ১৮ বছর হওয়ার আগেই পর্ন দেখে। একটি জনপ্রিয় পর্ন সাইটে প্রতিদিন ৯ কোটি ২০ লক্ষ ভিজিট হয়। সংখ্যাটা আরেকবার চিন্তা করুন— ৯ কোটি ২০ লক্ষ—প্রতিদিন। এর ৮০% ভাগ ভিজিট হয় মোবাইল এবং টেবলেট থেকে। [সূত্র: এনাফ.অর্গ]

আপনি যতই মনে করেন যে, আপনারা ভদ্র-বংশের পরিবার, অত্যন্ত ধার্মিক, পারিবারিক মূল্যবোধ বজায় রাখেন, আপনার সন্তানদেরকে ভালো-মন্দ শেখান — খুব একটা লাভ নেই। ইন্টারনেটে এমন সব মানুষ আপনার সন্তানদের সাথে যোগাযোগ করে, যারা খুব ভালো করে জানে কীভাবে আপনার দেওয়া সব শিক্ষাকে ভুলিয়ে দিয়ে তাদের পশু-প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলে অন্ধকার জগতে নিয়ে যেতে হয়।

তাই নিজেদেরকে এই যুগের উপযোগী করুন। ইন্টারনেট ব্যবহারে শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিন। বোঝার চেষ্টা করুন যে, তাদের হাতে কী দিয়েছেন। মানবজাতির সবচেয়ে বড় জ্ঞান-ভাণ্ডার এবং একইসাথে সবচেয়ে বড় অপরাধ-ভাণ্ডার তার হাতে আপনি তুলে দিয়েছেন। ইন্টারনেট হচ্ছে এক বিশাল লাইব্রেরি, যার এক-তৃতীয়াংশ বই হচ্ছে নোংরা যৌনতায় ভরা। আর এই লাইব্রেরিতে যারা বসে আছে, তাদের দশজনের একজন কুৎসিত রকমের যৌনতায় আসক্ত। সেই লাইব্রেরির অলিতে-গলিতে প্রকাশ্যে নগ্ন মানুষ নোংরা কাজ করছে। —এরকম একটা লাইব্রেরিতে সন্তানদের ঢুকিয়ে ছেড়ে দেওয়ার আগে নিজে প্রস্তুতি নিন, তারপর সন্তানদের প্রস্তুতি নেওয়া শেখান।

ইন্টারনেট না দিয়ে থাকতে পারবেন না। বাসায় না পেলে, বন্ধুর বাসায় গিয়ে ব্যবহার করবে। এজন্য সবচেয়ে ভালো হচ্ছে, বাসায় নিরাপদ ইন্টারনেট দিয়ে নিজের হাতে শিখিয়ে দেওয়া: সেখানে কী ধরনের অন্যায় হয় এবং কীভাবে নিজেকে সেগুলো থেকে দূরে রাখতে হয়।

লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় লেখকের ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইলে। 

আরও পড়ুন:

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান