কিয়ামত কবে হবে কেউ তা জানে না // রমযান রোজনামচা (৯)

Autumn leaves

কিয়ামত এসে গেল বলে – এরকম একটা কথা অনেকের কাছ থেকে আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। অচিরেই কিয়ামত ঘটে যাক বা না যাক, এর কিছু কিছু আলামত এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। আল্লাহ বলেন: فَهَلْ يَنظُرُونَ إِلَّا السَّاعَةَ أَن تَأْتِيَهُم بَغْتَةً ۖ فَقَدْ جَاءَ أَشْرَاطُهَا “তবে কি তারা এরই অপেক্ষা করছে যে, কিয়ামত তাদের উপর আকস্মিকভাবে আপতিত হবে? (যদি সেই অপেক্ষায়ই থাকে) তবে তার আলামতসমূহ তো এসে গেছে।” [কুরআন ৪৭:১৮]

শেষ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর দুনিয়ায় আগমন কিয়ামতের অন্যতম প্রধান একটি আলামত। তাঁর পরে আর কোনো নবী বা রাসুল আসবেন না। সেই হিসেবে, তিনি জন্মগ্রহণ করার সময় থেকেই শেষ যুগ শুরু হয়ে গেছে। কিয়ামতের অন্যতম একটি আলামত অবলোকনকারীর দৃষ্টিতে চাঁদ দ্বিখন্ডিত হওয়া তাঁর মক্কী জীবনেই বাস্তবায়িত হয়েছে। মক্কাবাসী ও মরুভূমির মুসাফিরেরা নিজের চোখে তা দেখেছে। অলৌকিক এই ঘটনার উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন: اقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانشَقَّ الْقَمَرُ “কিয়ামত এসে গেছে এবং চাঁদ ফেটে গেছে।” [কুরআন ৫৪:১]

সেই ঘটনারও প্রায় দেড় হাজার বছর পার হতে চলল। আমরা নিশ্চিতভাবেই কিয়ামতের আরও কাছাকাছি সময়ে চলে এসেছি।

নবীজির (ﷺ) হাতে চাঁদ দ্বিখন্ডিত হওয়ার মুজিযা ছাড়াও কিয়ামতের আরও কয়েকটি আলামতের কথা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। আকাশজুড়ে বিস্তৃত ধোঁয়ার প্রকাশ এর মধ্যে একটি। আল্লাহ বলেন: فَارْتَقِبْ يَوْمَ تَأْتِي السَّمَاءُ بِدُخَانٍ مُّبِينٍ. يَغْشَى النَّاسَ “সুতরাং সেই দিনের অপেক্ষা কর, যখন আকাশ স্পষ্ট ধোঁয়াশাচ্ছন্ন হয়ে দেখা দেবে – যা মানুষকে আচ্ছন্ন করবে।” [কুরআন ৪৪:১০-১১] কুরআন অবতীর্ণ হওয়াকালীন সময়ে একবার কঠিন দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ক্ষুধার তীব্রতায় মক্কাবাসীরা তখন আকাশ ধোঁয়াশাচ্ছন্ন দেখতে শুরু করে। এটি সেই ঘটনারই উল্লেখ হয়ে থাকলে কিয়ামতের এই আলামতটিরও  প্রকাশ তখনই হয়ে গিয়েছে। আবার এমনটিও হতে পারে যে, ভবিষ্যতের কোনো ঘটনার দিকে এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহই ভালো জানেন।

ইয়াজুজ ও মাজুজের ফিতনা কিয়ামতের আরেকটি বড় আলামত। আল্লাহ বলেন: حَتَّىٰ إِذَا فُتِحَتْ يَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَهُم مِّن كُلِّ حَدَبٍ يَنسِلُونَ “পরিশেষে যখন ইয়াজুজ ও মাজুজকে খুলে দেওয়া হবে এবং তাদেরকে প্রতিটি উঁচু ভূমি থেকে পিছলে নামতে দেখা যাবে।” [কুরআন ২১:৯৬] ইয়াজুজ ও মাজুজ কারা এবং তারা কীভাবে দুনিয়া জুড়ে ছেয়ে যাবে তার নানাবিধ ব্যাখ্যা আছে। এটি কুরআনের মুতাশাবিহ বা অস্পষ্ট আয়াতসমূহের মধ্যে একটি, ফলে এই বিষয়ে কোনো একটি নির্দিষ্ট ব্যাখ্যাকে অকাট্য বলে গ্রহণ করার সুযোগ আমাদের সামনে নেই। প্রকৃত ঘটনা কী ঘটবে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন।

মানুষের সাথে ‘কথা বলবে’ এরকম অদ্ভুত এক ‘জন্তুর’ আবির্ভাবকেও কিয়ামতের একটি আলামত হিসেবে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন: وَإِذَا وَقَعَ الْقَوْلُ عَلَيْهِمْ أَخْرَجْنَا لَهُمْ دَابَّةً مِّنَ الْأَرْضِ تُكَلِّمُهُمْ أَنَّ النَّاسَ كَانُوا بِآيَاتِنَا لَا يُوقِنُونَ “যখন তাদের সামনে আমার কথা পূর্ণ হওয়ার সময় এসে পড়বে, তখন তাদের জন্য ভূমি থেকে এক জন্তু বের করব, যা তাদের সাথে কথা বলবে, যেহেতু মানুষ আমার আয়াতসমূহে ঈমান আনছিল না।” [কুরআন ২৭:৮২] এটিও একটি মুতাশাবিহ আয়াত। ঘটনাটি বাস্তবে যখন ঘটবে কেবলমাত্র তখনই এর প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারা যাবে।

এর বাইরে, হাদিস গ্রন্থসমূহে প্রিয় নবী (ﷺ) থেকে কোনোটি নির্ভরযোগ্য ও কোনোটি অনির্ভরযোগ্য সূত্রে কিয়ামতের আরও অনেক আলামতের বর্ণনা পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কোনো কোনোটির প্রকাশ এরই মধ্যে ঘটে গিয়েছে। কয়েকটি আলামতের প্রকাশ ঘটেছে কি ঘটেনি তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। কিছু কিছু আলামতের বহিঃপ্রকাশ এখনও ঘটেনি।

কিয়ামতের এসব আলামতের প্রকাশ নিজের চোখের সামনে ঘটে যেতে দেখলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (ﷺ) প্রতি আমাদের ঈমান আরও দৃঢ় হয়। এর ফলে আমরা আগের চেয়ে বেশি সতর্ক হয়ে নিজেদের সংশোধিত ও পরিশুদ্ধ করার দিকে মনোনিবেশ করতে পারি। কিন্তু, এসব নিয়েই সবসময় পড়ে থাকা কোনো কাজের কথা নয়। কিয়ামত ও তার আলামতসমূহের প্রকাশকাল গাইব বা অদৃশ্যজগতের একটি বিষয়। নিছক অনুমানের ভিত্তিতে এসব ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা অনুচিত।

আমাদের নবীজিকেও (ﷺ) কিয়ামতের দিনক্ষণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। এর জবাবে আল্লাহ তাঁকে বলতে বলেন: يَسْأَلُونَكَ عَنِ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا ۖ قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِندَ رَبِّي ۖ لَا يُجَلِّيهَا لِوَقْتِهَا إِلَّا هُوَ ۚ ثَقُلَتْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ لَا تَأْتِيكُمْ إِلَّا بَغْتَةً ۗ يَسْأَلُونَكَ كَأَنَّكَ حَفِيٌّ عَنْهَا ۖ قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِندَ اللَّهِ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ “(হে রাসুল!) লোকে তোমাকে কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তা কখন ঘটবে? বলে দাও, এ বিষয়ের জ্ঞান কেবল আমার প্রতিপালকেরই আছে। তিনিই তা যথাসময়ে প্রকাশ করে দেখাবেন, অন্য কেউ নয়। আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর জন্য তা অতি ভারী বিষয়। তোমাদের কাছে যখন তা আসবে হঠাৎ করেই আসবে। তারা তোমাকে এমনভাবে জিজ্ঞেস করে, যেন তুমি তা সম্পূর্ণরূপে জেনে রেখেছ। বলে দাও, তার জ্ঞান কেবল আল্লাহরই কাছে রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ (এ বিষয়ে) জানে না।” [কুরআন ৭:১৮৭]

মানুষকে যে বিষয়ের সুনির্দিষ্ট জ্ঞান দেওয়া হয়নি তাকে কেন্দ্র করে অভিনব কোনো মতবাদের দিকে কেউ আহ্বান করলে সেই বিষয়ে অবশ্যই সাবধান থাকতে হবে। কিয়ামত কবে হবে তা নিয়ে বিচলিত না হয়ে বরং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য আমি কী পাথেয় সংগ্রহ করতে পারলাম তা নিয়েই আমাদের বেশি তৎপর থাকা উচিত।

1 comments

  1. […] নাগাদ আসতে পারে? কিয়ামত কবে হবে, সেটা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না, তাই সেই ব্যাপারে ভবিষ্যতবাণী করা […]

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান