পরিবারের শান্তিকে অশান্তিতে পরিবর্তিত করতে শয়তানের ষড়যন্ত্র

নবী ইয়াকুব (আ.)-এর ছিল বারো ছেলে। আগের ঘরের দশজন, আর পরের ঘরের ইউসুফ ও বিনয়ামিন। এদের সবার মধ্যে ইউসুফের প্রতি তাঁর টান ছিল সবচেয়ে বেশি। তো, তাঁর পছন্দের এই ছোট ছেলেটি একদিন একটি স্বপ্ন দেখল। সদ্য দেখা সেই স্বপ্নের বর্ণনা দিয়ে সে বলল, يَـٰٓأَبَتِ إِنِّى رَأَيْتُ أَحَدَ عَشَرَ كَوْكَبًا وَٱلشَّمْسَ وَٱلْقَمَرَ رَأَيْتُهُمْ لِى سَـٰجِدِينَ “হে আমার পিতা! আমি দেখেছি এগারটি নক্ষত্র, সূর্য ও চাঁদকে; আমি দেখেছি তাদেরকে আমার প্রতি সিজদায় অবনত অবস্থায়।” [কুরআন ১২:৪]

আল্লাহর নবী হওয়ার সুবাদে ইয়াকুব (আ.) ইউসুফের দেখা এই স্বপ্নের তাৎপর্য সাথেসাথেই বুঝে ফেললেন। কিন্তু, আগের ঘরের ছেলেরা তা জেনে ফেললে ইউসুফের বিপদ হতে পারে বিধায় এই বিষয়ে তাকে বিশেষভাবে সাবধান করে দিয়ে তিনি বললেন, يَـٰبُنَىَّ لَا تَقْصُصْ رُءْيَاكَ عَلَىٰٓ إِخْوَتِكَ فَيَكِيدُوا۟ لَكَ كَيْدًا ۖ إِنَّ ٱلشَّيْطَـٰنَ لِلْإِنسَـٰنِ عَدُوٌّ مُّبِينٌ “বাছা! তোমার স্বপ্নের কথা তোমার ভাইদের কাছে বর্ণনা কোরো না; যদি করো তাহলে তারা তোমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবে। শয়তান তো মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।” [কুরআন ১২:৫]         

আগের ঘরের দশ ভাই এরই মধ্যে নিজেদেরকে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত বলে মনে করতে শুরু করে দিয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে অন্যায্য এই অবস্থানের পরিবর্তন কীভাবে ঘটানো যায় তা নিয়ে তারা নিজেরা শলাপরামর্শে বসল। সেখানে কথা উঠল, إِذْ قَالُوا۟ لَيُوسُفُ وَأَخُوهُ أَحَبُّ إِلَىٰٓ أَبِينَا مِنَّا وَنَحْنُ عُصْبَةٌ إِنَّ أَبَانَا لَفِى ضَلَـٰلٍ مُّبِينٍ “আমাদের পিতার নিকট ইউসুফ আর তার ভাইই অধিক প্রিয়, অথচ আমরা একটি সংহত দল; আমাদের পিতা তো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই রয়েছেন।” [কুরআন ১২:৮]

পূর্ণবয়স্ক ভাইবোনের মধ্যে রেষারেষি ও মনোমালিন্য কমবেশি সব পরিবারেই হয়ে থাকে। সময়ে সময়ে পিতামাতা ও সন্তানের মধ্যেকার সম্পর্কেও ফাটল ধরে। আর শাশুড়ি-বউ চিরায়ত দ্বন্দের কথা তো সবারই জানা। প্রায়শই দেখা যায়, তিলকে তাল বানিয়ে উপস্থাপন করে শয়তান দ্রুতই পরিস্থিতিকে অবনতিশীল অবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিবাদমান পক্ষসমূহকে ক্রমাগত ফুসলায়। যৌথ পরিবার ব্যবস্থায় এই অঘটনটি সবচেয়ে বেশি ঘটে। আর পিতার একাধিক স্ত্রী থেকে থাকলে এবং তারা সবাই একইসাথে বসবাস করলে সতীন ও কয়েক ঘরের সন্তান মিলে সবাইকে রীতিমতো নাকাল হতে হয়।

দশ ভাইয়ের গোপন ওই বৈঠকে একজনের কাছ থেকে পরামর্শ এল, ٱقْتُلُوا۟ يُوسُفَ أَوِ ٱطْرَحُوهُ أَرْضًا يَخْلُ لَكُمْ وَجْهُ أَبِيكُمْ “ইউসুফকে হত্যা করো, অথবা তাকে কোনো স্থানে ফেলে এসো; তাহলে তোমাদের পিতার আনুকূল্য শুধু তোমাদেরই থাকবে।” [কুরআন ১২:৯]     

মুখ কালো করা থেকে শুরু করে খুনোখুনি – পারিবারিক কলহের ‘নিরসনে’ এমন কোনো কুবুদ্ধি নেই যা শয়তান মানুষকে দেয় না। কেবলই পিতার আনুকূল্য পাওয়ার মোহে নিজ ভাইকে মেরে ফেলার মন্ত্রণা এই মহা প্রবঞ্চকের কাছ থেকেই আসতে পারে।     

শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে বুদ্ধিটা যে সে খারাপ দিচ্ছিল তা কিন্তু সে ঠিকই বুঝতে পারছিল। আর তাই তো ওই কুপরামর্শ দেওয়ার পরপরই সে এ-ও বলল, وَتَكُونُوا۟ مِنۢ بَعْدِهِۦ قَوْمًا صَـٰلِحِينَ “… তারপর তোমরা ভালো লোক হয়ে যাবে।” [কুরআন ১২:৯] এভাবে কি ভালো হওয়া যায়!        

এক ভাইয়ের মন তাতে সায় দিলো না। সে বলল, لَا تَقْتُلُوا۟ يُوسُفَ وَأَلْقُوهُ فِى غَيَـٰبَتِ ٱلْجُبِّ يَلْتَقِطْهُ بَعْضُ ٱلسَّيَّارَةِ إِن كُنتُمْ فَـٰعِلِينَ “ইউসুফকে হত্যা করো না। আর যদি কিছু করোই, তাহলে তাকে কোনো কূপের গভীরে ফেলে দাও; কোনো যাত্রীদল তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে।” [কুরআন ১২:১০]      

এরই ধারাবাহিকতায় নিজেদেরই ছোট ভাই ইউসুফকে তারা ঠিকই একটি কুয়ার মধ্যে ফেলে দিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। এরপর পানির সন্ধানে আসা একটা কাফেলা তাকে খুঁজে পায়। অল্প কিছু পয়সার বিনিময়ে তারা তাকে মিসরের এক মন্ত্রীর কাছে বিক্রি করে দেয়। দশ ভাইয়ের ঈর্ষা নিতান্তই সাধারণ একটি বালককে নিজ পিতামাতার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বানিয়ে দিলো একজন কৃতদাস!  

ইউসুফ ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন। এক পর্যায়ে মনিবের স্ত্রী তার দিকে কুনজর দিতে শুরু করল। এরই পরিণতিতে মিথ্যা অভিযোগ মাথায় নিয়ে তাকে দীর্ঘ কারাভোগ করতে হয়। অনেক বছর পরে রাজার দেখা একটি স্বপ্নের মনপুত ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারার বদৌলতে সসম্মানে মুক্তি দিয়ে তাকে মিসরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে বসানো হলো। সেই পদে অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় সাত বছর স্থায়ী দীর্ঘ একটি দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সাফল্যের সঙ্গে সামাল দিতে তিনি সক্ষম হলেন। এতে করে মিসরে তাঁর অবস্থান আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হলো।           

লাগাতার বাঁক বদলে পরিপূর্ণ জীবনের এক পর্যায়ে এসে ইউসুফ আবারও তাঁর সেই ভাইদের দেখা পেলেন। তখন তিনি মিসরের মহা ক্ষমতাশালী একজন প্রশাসক, আর তারা দূর দেশ থেকে ত্রাণের আশায় আসা উদ্বাস্তু। এখন কি আর ইউসুফকে অবজ্ঞা করা চলে!  

প্রতিশোধ গ্রহণের পূর্ণ ক্ষমতা থাকার পরেও মহানুভব ইউসুফ তাদেরকে মাফ করে দিলেন। পিতা ইয়াকুবকেও মিসরে আনানোর ব্যবস্থা করলেন। পিতামাতা ও এগার ভাই মিলে তাঁকে সম্মানসূচক কুর্নিশ করার মধ্য দিয়ে শৈশবে দেখা তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত হওয়ার পর তিনি বললেন, وَقَالَ يَـٰٓأَبَتِ هَـٰذَا تَأْوِيلُ رُءْيَـٰىَ مِن قَبْلُ قَدْ جَعَلَهَا رَبِّى حَقًّا “হে আমার পিতা! এটাই আমার পূর্বেকার স্বপ্নের ব্যাখ্যা; আমার প্রতিপালক তা বাস্তবে পরিণত করেছেন।“ [কুরআন ১২:১০০] 

জীবনভর এত কষ্ট সহ্য করার পরেও এই সুযোগে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেও তিনি ভুললেন না। ইউসুফ (আ.) বললেন, وَقَدْ أَحْسَنَ بِىٓ إِذْ أَخْرَجَنِى مِنَ ٱلسِّجْنِ وَجَآءَ بِكُم مِّنَ ٱلْبَدْوِ مِنۢ بَعْدِ أَن نَّزَغَ ٱلشَّيْطَـٰنُ بَيْنِى وَبَيْنَ إِخْوَتِىٓ ۚ إِنَّ رَبِّى لَطِيفٌ لِّمَا يَشَآءُ ۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلْعَلِيمُ ٱلْحَكِيمُ “… তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যখন তিনি আমাকে কারাগার থেকে বের করে এনেছেন। আর শয়তান আমার ও আমার ভাইদের সম্পর্ক নষ্ট করার পরও আপনাদেরকে মরু অঞ্চল হতে এখানে এনে দিয়ে আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আমার প্রতিপালক যা করতে ইচ্ছে করেন তা সূক্ষ্ণ উপায়ে বাস্তবায়িত করে থাকেন; তিনি বড়ই বিজ্ঞ, বড়ই প্রজ্ঞাময়।” [কুরআন ১২:১০০] এখানে লক্ষ্যণীয় যে, ভাইয়ে-ভাইয়ে সম্পর্ক নষ্ট করার এই ষড়যন্ত্রে ইউসুফ (আ.) শয়তানকেই দুষেছেন।  

আমাদের একেকজনের সংসারেও একজনের সাথে আরেকজনের সম্পর্ক নষ্ট করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি শয়তান রাখে না। যতক্ষণ না কেউ কারও জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, বা সামগ্রিক পরিস্থিতি অসহনীয় পর্যায় পর্যন্ত গিয়ে গড়াচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত শয়তানের কুমন্ত্রণায় কান না দিয়ে পারিবারিক এই সম্পর্কসমূহ অটুট রাখতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত।

2 comments

  1. […] উদ্ধুদ্ধ করা, মানুষে-মানুষে এমনকি পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও বিভেদ ও বিভাজনের বীজ বপন করা, মদ, […]

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান