কেবলই কুমন্ত্রণা দেওয়া ছাড়া শয়তানের ক্ষমতা একেবারেই শূন্য

সুখদ কাননের সেই ঘটনারও আগে স্রেফ অহংকারের বশবর্তী হয়ে এক সময়কার আবেদ ইবলিস আল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ একটি আদেশ মানতে রীতিমতো অস্বীকৃতি জানিয়ে বসেছিল। ফেরেশতারা আল্লাহর সেই আদেশ অনুযায়ী কাজ করলেও জিন জাতির ইবলিস বেঁকে বসল। অত্যন্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ উপায়ে কুযুক্তির আশ্রয় নিয়ে আল্লাহর অবাধ্য হয়ে আমাদের আদি পিতা আদমের সামনে সে নত হলো না। এরই শাস্তিস্বরূপ অভিশপ্ত অবস্থায় সেখান থেকে তাকে বহিষ্কার করে দিয়ে আল্লাহ বললেন, فَٱخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ. وَإِنَّ عَلَيْكَ ٱللَّعْنَةَ إِلَىٰ يَوْمِ ٱلدِّينِ “বেরিয়ে যা এখান থেকে, কারণ তুই হলি অভিশপ্ত। বিচার দিবস পর্যন্ত তোর উপর থাকল লা’নত।” [কুরআন ১৫:৩৪-৩৫]             

এই পর্যায়ে এসেও নিজের ভুল বুঝতে পারলে না হয় একটা কথা ছিল। কিন্তু, তা না করে নিজের জেদের উপর সে আরও অটল হয়ে গেল। শুধু তা-ই নয়, একান্তই নিজের দোষে ভ্রান্তপথে পতিত হওয়ার পরেও তার এই স্খলনের জন্য আল্লাহকেই সে দায়ী করে বসল। ফেরেশতাদের মর্যাদাপূর্ণ মজলিস থেকে অভিশপ্ত অবস্থায় সদ্য বহিষ্কৃত ইবলিস আরও একবার ঔদ্ধত্য দেখিয়ে বলল, رَبِّ بِمَآ أَغْوَيْتَنِى لَأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِى ٱلْأَرْضِ وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ. إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ ٱلْمُخْلَصِينَ “হে আমার প্রতিপালক! যেহেতু আপনি আমাকে ভ্রান্তপথে ঠেলে দিলেন, কাজেই আমিও পৃথিবীতে মানুষের কাছে পাপকাজকে অবশ্য অবশ্যই সুশোভিত করে দেখাব আর তাদের মধ্য থেকে আপনার একান্ত বান্দাগণ ছাড়া তাদের সবাইকে অবশ্য অবশ্যই বিভ্রান্ত করব।” [কুরআন ১৫:৩৯-৪০]   

শয়তান তার সেই কথা রেখেছে। অভাবের ভয় দেখিয়ে ও অশ্লীলতার দিকে আহ্বান করে অথবা আল্লাহর বিধিবিধানকে বিস্মৃত করিয়ে দিয়ে নিষিদ্ধ কাজ করতে উদ্ধুদ্ধ করা, মানুষে-মানুষে এমনকি পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও বিভেদ ও বিভাজনের বীজ বপন করা, মদ, জুয়া, প্রতিমাপূজা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন কাজকর্মকে সুশোভিত আকারে উপস্থাপন করা ইত্যাদি নানাবিধ উপায়ে একেকজন মানুষকে একেক উপায়ে তার পথে সে দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছে।                

অভিশপ্ত অবস্থায় বহিষ্কৃত হওয়ার সেই সঙ্গিন সময়েও অনুতপ্ত হওয়ার বদলে কিয়ামত অবধি আদম সন্তানের সাথে এসব কুকর্ম করে যাওয়ার জন্যই আল্লাহর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে সে বলেছিল, رَبِّ فَأَنظِرْنِىٓ إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ “হে আমার প্রতিপালক! তাহলে আমাকে অবকাশ দিন সেই দিন পর্যন্ত, যেদিন তাদেরকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে।” [কুরআন ১৫:৩৬] সে আরও বলল, فَبِمَآ أَغْوَيْتَنِى لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَٰطَكَ ٱلْمُسْتَقِيمَ. ثُمَّ لَـَٔاتِيَنَّهُم مِّنۢ بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَـٰنِهِمْ وَعَن شَمَآئِلِهِمْ ۖ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَـٰكِرِينَ “অবশ্যই আমি তাদের জন্য আপনার সোজা পথে ওঁত পেতে বসে থাকব। তারপর অবশ্যই তাদের নিকট উপস্থিত হব – তাদের সামনে থেকে ও তাদের পেছন থেকে এবং তাদের ডান দিক থেকে ও তাদের বাম দিক থেকে। আর আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না’।” [কুরআন ৭:১৬-১৭] আল্লাহ বললেন, فَإِنَّكَ مِنَ ٱلْمُنظَرِينَ. إِلَىٰ يَوْمِ ٱلْوَقْتِ ٱلْمَعْلُومِ “অবধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত তোকে সময় দেওয়া হলো।” [কুরআন ১৫:৩৭-৩৮]          

ইবলিস আল্লাহকে মানেনি, আমরা মেনেছি। তার এহেন দুআ-ও যদি আল্লাহ কবুল করে থাকেন তাহলে আমাদের মতো বিশ্বাসী কিন্তু পাপীদের দুআ-ও তিনি কবুল করবেনই অন্তত এতটুকু ঈমান আমাদের প্রত্যেকেরই অবশ্যই রাখা উচিত।  

পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত তাকে সময় দেওয়ার সময়ে শয়তানকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ আরও বললেন, وَٱسْتَفْزِزْ مَنِ ٱسْتَطَعْتَ مِنْهُم بِصَوْتِكَ وَأَجْلِبْ عَلَيْهِم بِخَيْلِكَ وَرَجِلِكَ وَشَارِكْهُمْ فِى ٱلْأَمْوَٰلِ وَٱلْأَوْلَـٰدِ وَعِدْهُمْ ۚ وَمَا يَعِدُهُمُ ٱلشَّيْطَـٰنُ إِلَّا غُرُورًا “তোর আহ্বানে তাদের মধ্য থেকে যাকে পারিস সত্যচূত কর, তোর অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী দ্বারা তাদেরকে আক্রমণ কর এবং তাদের ধন-সম্পদে ও সন্তান-সন্ততিতে শরীক হয়ে যা, এবং তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দে।” [কুরআন ১৭:৬৪]    

ইবলিসকে যদি এভাবে সুযোগ দেওয়া না হতো তাহলে কেউ আমাদের কুমন্ত্রণা দিতে পারত না, আর আমরাও পথচ্যুত হতাম না — এরকম একটা চিন্তা আমাদের কারও কারও মাথায় সময়ে সময়ে এসে থাকা অসম্ভব নয়। এই বিষয়ে এতটুকু জেনে রাখা-ই যথেষ্ট যে, তাঁর অসীম প্রজ্ঞা অনুযায়ীই আল্লাহর তরফ থেকে এই সিদ্ধান্ত এসেছে। মানুষকে কুমন্ত্রণা দেওয়ার ক্ষমতা তাকে দেওয়া হলেও আমাদেরকে দিয়ে জোর করে কোনো কাজ করিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কিন্তু শয়তানকে কখনোই দেওয়া হয়নি। ফলে, আল্লাহ প্রদত্ত বুদ্ধি ও বিবেকের ব্যবহার না করে বোকার মতো তার পাতা ফাঁদে পা দিলে এর চুড়ান্ত দায়ভার আসলে আমাদের নিজেদের উপরেই বর্তায়।  

এছাড়াও, কেবলই বুদ্ধি ও বিবেকের উপর আমাদেরকে পুরোপুরি ছেড়ে না দিয়ে সৎপথের নির্দেশনা সম্বলিত কিতাবও আল্লাহ পাঠিয়েছেন। এতগুলো উপায়ে ভালো ও মন্দের প্রভেদ আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দেওয়ার পর অজুহাত দেখানোর কোনো সুযোগ আর অবশিষ্ট থাকে না। এই বিষয়টিই আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে আল্লাহ বলেন, فَإِن زَلَلْتُم مِّنۢ بَعْدِ مَا جَآءَتْكُمُ ٱلْبَيِّنَـٰتُ فَٱعْلَمُوٓا۟ أَنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ “তোমাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ আসার পরেও যদি তোমরা পদস্খলিত হও তবে জেনে রেখ, আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।“ [কুরআন ২: ২০৯] 

শয়তানের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সদা সচেতন ও সতর্ক তো আমাদের থাকতেই হবে, তবে আল্লাহর বান্দা হয়ে থাকলে তাকে অত ভয় পাওয়ারও আসলে কিছু নেই। মানুষকে পথভ্রষ্ট করা সংক্রান্ত তার সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করার সময়েই তাকে সাফ বলে দেওয়া হয়েছিল, إِنَّ عِبَادِى لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَـٰنٌ إِلَّا مَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلْغَاوِينَ “তোকে যারা অনুসরণ করে সেই বিভ্রান্তরা ছাড়া আমার প্রকৃত বান্দাদের উপর তোর কোনো আধিপত্য চলবে না।” [কুরআন ১৫:৪২]       

অতএব, নিজেদের অপকর্ম এবং নৈতিক ও চারিত্রিক স্খলনের দায় শয়তানের উপর না চাপিয়ে বরং আত্মসমালোচনা ও আত্মসংশোধনে আমাদের অধিক মনোযোগী হওয়া উচিত।  

1 comments

  1. […] দেখা পাওয়া ভার। তার দৌড় অবশ্য কুবুদ্ধি দেওয়া পর্যন্তই। যে তাতে সাড়া দেবে তারই ক্ষতি, আর যে […]

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান