রাসুলের মতো রমজান পালন করবেন যেভাবে

তখন আমার বয়স কত হবে? পাঁচ কি ছয়।

আমরা থাকতাম এক রুমের এক বাসায়। এক রুম হলেও রুমটা ছিল অনেক বড়।

একপাশে বড় সাইজের বিছানা ছিল। আরেক দিকে ছিল শোকেস। শোকেসের সামনে খাবার টেবিল। বিছানার উলটো দিকে ছিল এক সিটের একটা সোফা। সেই সোফাটা আজও আছে।

টেবিল থাকলেও আমরা অনেক সময় খেতাম নিচে পাটি বিছিয়ে।

তখন রোজা হতো শীতকালে। আম্মা প্রায় প্রতিদিন আমাকে সেহরিতে জাগিয়ে দিতেন। আমি থাকতাম আধো ঘুমে, আধো জেগে। আম্মা আমাকে দুধভাত খাইয়ে দিতেন। কখনো কখনো অবশ্য নিজেও খেতাম। তবে বেশিরভাগ দিন আম্মাই খাইয়ে দিতেন। গরুর দুধের সাথে ভাত—সেই স্বাদ সেই দিন আজ কোথায়!

তখন রোজা ছিল অনেক ‘সাদামাটা’। আজকের মতো এত ‘প্ল্যান’, ‘প্ল্যানার’ এত তাত্ত্বিক কচকচানি ছিল না। শবে কদর বা তারাবি নিয়ে অহেতুক তর্কবিতর্ক হতো না। মানুষগুলি ছিল অতি সরলসিধা।

মিডিয়া বলতে তখন সবেধন নীলমণি ছিল বিটিভি। সেই বিটিভিও শুরু হতো বিকাল ৩টায়। সারা দিন মানুষ নিজের নিজের কাজেই মশগুল থাকত। আজকের মতো গান শুনে সিনেমা দেখে রিলস দেখে রোজা বরবাদ করত না।

আমাদের পরিবার ছিল ছোট। আমি, আমার এক ছোট বোন, আর আব্বা-আম্মা। ইফতারের সামান্য আয়োজন বাদ দিলে বেশিরভাগ সময় আম্মা অবসর। রোজার দিনে সকালে বা দুপুরে আম্মা এক এক পারা কুরআন পড়তেন। কখনো দুপুরে শেষ না হলে ইফতারের পরে পড়তেন।

আমি যখন কুরআন পড়া শিখলাম, আমি আর আম্মা মিলে পাল্লা দিতাম। আমার শেষ হতো ৪৫ মিনিটে। আম্মার লাগত প্রায় ১ ঘন্টা। ৩০ দিনে ৩০ পারা। কই, এখন যে এত ‘টাইম ম্যানেজমেন্ট’ আর ‘প্ল্যানার’-এর কৌশল জানি, এখন তো দেখি পারি না।

আম্মাও এখন আর পারে কি না জানি না। বাসায় কিন্তু এখন আম্মার দুটা কাজের লোক। কিন্তু ওই যে আগের সেই ‘সাদামাটা’ ‘অনুন্নত’ জীবন—সেই জীবন তো আর নেই। প্রযুক্তি এসেছে। জীবন ‘সহজ’ হয়েছে। সহজ করে জীবনকে আজ ‘প্রযুক্তি’ ঘূর্ণিজালে ডুবিয়ে দিয়েছে।

রমজানে রাসুলের দিনগুলিও ছিল সরল সাধারণ। সেহরি পাঁচ-ওক্ত-নামাজ ইফতার কুরআন-তিলাওয়াত তাহাজ্জুদ—এই তো তাঁর রমজান। কোনো কোনো রমজানে তিনি ﷺ রণমঞ্চে ছিলেন সত্য। কিন্তু মোটের ওপর রমজান তো এ-ই: সেহরি-নামাজ-ইফতার-তারাবি।

কোনো গালিবকা নেই, গলা চড়ানো নেই, ফালতু কাজে সময় নষ্ট নেই, দুই নম্বরি নেই, আজেবাজে জিনিস দেখা নেই, শোনা নেই; আছে শুধু আল্লাহর কাছাকাছি হওয়ার রেস—সেই রেসে পাঁচ ওক্তের ফরজ নামাজ আছে, স্বল্প সেহরি অল্প ইফতার আছে; আর আছে সাধ্যমতো তাহাজ্জুদ-তারাবি-কিয়ামুল্‌লাইল, কুরআন তিলাওয়াত

এই সহজ-সাধারণ রমজান খোদ ধার্মিক মুসলিমদের কাছেও কেন আজ এত ‘আয়োজন’ আর ‘প্ল্যানিং’-এ রূপ নিল? রোজার যে আসল স্পিরিট—ধার্মিকতার মাত্রা বাড়ানো, এই সিম্পল আইডিয়াটা কোথায়? রমজানের রোজাও কি এখন ‘ভিউ’ বাড়ানোর মতো সংখ্যা বাড়ানোয় আটকে গেল?

সহজ করাই কঠিন। সিম্প্লিসিটির মাঝেই স্পিরিচুয়ালিটি। না হয় অনেক কিছু না-ই হলো। কিন্তু আমার রমজান আমার রোজা হলো রাসুলের মতো সহজ-সাধারণ-সাদাকালো। নিউ ইয়ার’স রেজুলেশনের মতো অত শত করে ফেলার প্ল্যান করায় কাজ নেই আমার। নামাজ পড়ব, রোজা রাখব, আজেবাজে কথা বলব না, দেখব না, শুনব না—আমরা রমজান রাসুলের মতো সাদাকালো হলেই আমি খুশি।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান