ক্রুসেডারদের কবল থেকে আল-আকসা যেভাবে মুক্ত হয়েছিল (অনুবাদ)

মূল খুতবা: ড. ইয়াসির কাযী

১০৯৯ এর জুলাই। আল-আকসাতে গণহত্যা চলছে। মানুষজন জান বাঁচাতে পালাচ্ছে ওখান থেকে। তাদের একদল মসজিদুল আকসা থেকে কুরআনের সবচাইতে প্রাচীন মুসহাফটা নিয়ে গেলো। বলা হয়ে থাকে, এই মুসহাফটি হলো উসমান রাদিআল্লাহু আনহু হতে বরাদ্ধকৃত সেই চারটি প্রধান মুসহাফের একটি। সেটা আকসার গোপন এক স্থানে রাখা ছিল।

তারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে সেই কুরআন নিয়ে শহর থেকে পালিয়ে গেলেন। পালিয়ে কাছের সবচাইতে বড় শহরে উঠলেন। দামেস্ক। শহরে ঢুকেই সর্বপ্রথম তারা উমাউই মসজিদে ছুটে গেলেন। শহরের প্রধান কাযী, যাইনুল ইসলাম আল-হারাউই তখন দামেস্কের সেই মসজিদে হালাকা দিচ্ছিলেন। এমন সময়ে সবাই দেখতে পেলো একদল ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত উদ্বাস্তু মানুষ মসজিদে ঢুকে চিৎকার করছে। ভিড় জমে গেলো তাদের চারপাশে।

কী হলো? সমস্যা কী?

তারা বলল, “আফ্রাঞ্জ অর্থাৎ ফ্রেঞ্চরা আকসা আক্রমণ করেছে। আমরা কয়েকজন মাত্র বাঁচতে পেরেছি। এই যে আমাদের হাতে উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর মুসহাফ।” তারা সবাইকে তাদের নিজের চোখে দেখা সমস্ত ঘটনা বর্ননা করা শুরু করলো। কীভাবে ওরা হাজার হাজার নারী, শিশু হত্যা করেছে নির্দয়ভাবে। জেরুজালেমের রাস্তাঘাট কীভাবে রক্তের বন্যায় ভেসে গেছে। এসব শুনে যাইনুল ইসলাম আল হারাউই ভাবলেন, কিছু একটা করতেই হবে।

একটা বিষয় খেয়াল করুন, ফিতনার সময়, যুদ্ধের সময়, দুঃখ-দুর্দশা সংগ্রামের সময়ে কিছু আলেম দরস তাদরিসের মধ্যেই ডুবে থাকতে চান। তারা বলেন, এগুলো আমাদের বিষয় না। তবে আলেমদের আরেকটি অংশ কিন্তু ঠিকই তাদের দায়িত্ব বুঝে ফেলেন। তারা বোঝেন, শাসক যদি কিছু না করে তবে জনগনকে জাগ্রত করা উলামাদেরই দায়িত্ব।

হারাউই ঠিক করলেন, তিনি বাগদাদে ফিরে যেয়ে খলিফাকে দিয়ে মসজিদুল আকসা উদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। তিনি নিজের হাতের কিতাব বন্ধ করে দিলেন। আর দারস চলবে না। এখন দারস তাদরিসের সময় না। মসজিদুল আকসা পুড়ছে। তাই তিনি মকতব বন্ধ করে দামেস্ক থেকে বাগদাদ যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। বাগদাদ আব্বাসি খেলাফতের রাজধানী। খলিফাকে বোঝাতেই হবে। তিনি সেই লোকদের কয়েকজনকেও নিয়ে গেলেন তার সাথে। তাদের নিয়েই তিনি আব্বাসি খলিফার সামনে সমস্ত আবেদন দাখিল করবেন।

তো তিনি বাগদাদ গেলেন। খলিফার সাথে সাক্ষাৎ করবার চেষ্টা করছেন, কিন্তু খলিফার কর্মচারীরা দিচ্ছে না। “আপনার সাথে দেখা করবার সময় নেই খলিফার। ওনার হাতে সময় নেই এখন।” এভাবে কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে গেলো। দেখুন, তিনি হলেন পুরো মুসলিম বিশ্বের খলিফা। যখন তখন তো দেখা পাওয়া যম্ভব না। খলিফার সাথে দেখা করাটা ঝক্কি ঝামেলার বিষয়।

তিনি চেষ্টা করছেন তো করছেন। কিছুই হচ্ছে না।

এক শুক্রবার। বাগদাদের সবচাইতে বড় মসজিদে জুম্মার খুতবা চলছে। সবাই খুতবা শুনছে। এমন সময়ে তিনি মসজিদের ভেতর ঢুকে পড়লেন।

এই মসজিদে সামনের ডানদিকে একটি ব্যক্তিগত চেম্বার বানানো আছে শুধুমাত্র খলিফার জন্যে। তিনি প্রাসাদ থেকে গোপন এক সুড়ঙ্গের মাধ্যমে এটাতে জুম্মার নামায পড়ে আবার প্রাসাদে ফিরে যান। মানুষের সাথে তার দেখা সাক্ষাৎ কিছুই হয় না। আবু বকর, ওমরের যুগ আর নেই। খলিফারা জনমানুষের সাথে সাক্ষাৎ করেন না আর।

এমন সময়েই যাইনুল ইসলাম আল হারাউই মসজিদে ঢুকে সোজা সবার সামনে চলে এলেন। ওটা রমযান মাস ছিল। সবার সামনে একটি রুটি নিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলেন!

এখন আপনারাই বলুন, মুসলিম কোনো সমাজে রমযানের দিনের বেলা প্রকাশ্যে কেউ খেলে কী অবস্থা হবে? কী করবে সবাই?

হইচই শুরু হয়ে গেলো!

সবাই দাঁড়িয়ে গেলো। আপনি পাগল হয়ে গেছেন নাকি? কতো বড় সাহস! আসতাগফিরুল্লাহ! রমযানের দিনে আপনি মসজিদে দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন! আপনার মাথা ঠিক আছে?!?!

তখন তিনি সবাইকে বললেন, “রমযানে শুধুমাত্র এক টুকরো রুটি খাবার দোষে তোমরা আমার উপর এতো ক্ষিপ্ত! কিন্তু যখন আকসাতে আগুন লেগে গেলো, তখন তোমাদের এই আবেগ কোথায় ছিল? কোথায় গেলো সেই ক্রোধ? কোথায় সেই রাগ? রমযানের দিনের বেলা একজন মুসলিম একটু খেয়েছে বলে তোমাদের এতো হইচই, অথচ দেড় লক্ষ মুসলিম মরেই গেলো, আর তোমাদের টু শব্দ নেই!”

সবার মুখ বন্ধ হয়ে গেলো। তিনি বললেন, “এই যে আমি এই উদ্বাস্তুদের নিয়ে এসেছি—তাদের দেখিয়ে বললেন—তারা নিজের চোখে দেখেছে। আর আমি হলাম দামেস্কের প্রধান কাযী। আমি নিজে এসেছি।”

তখন তো কোন ইন্টারনেট ছিল না যে সবাই চিনবে। নিজের পরিচয় তো দিতেই হবে।

“আমি এখানে এসেছিলাম খলিফার সাথে দেখা করে তার সাহায্য চাইতে। অথচ তিনি আমাদের সাথে সাক্ষাৎ পর্যন্ত করেননি!”

এভাবে হইচই তৈরি করে অবশেষে তিনি খলিফার সাথে দেখা করার অনুমতি পেলেন।

খলিফার দরবারে তাঁর পূর্ণ আলোচনাটি আমরা জানি না। কিন্তু সেটার প্রভাব বুঝতে পারি। ইতিহাসবিদগন বলেন যে, তাঁর ভাষণ শুনে দরবারের সকলে চুপ হয়ে গেলো। কেউ কেউ কাঁদছিল। এমনকি খোদ খলিফা পর্যন্ত মাথা নিচু করে ছিল লজ্জায়। তাঁর দুয়েকটি কথা শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতায় এসেছে। তিনি খলিফাকে বলছেন, “এখানে আপনি প্রাসাদে বসে বসে বিলাসী জীবন উপভোগ করছেন”, আঙ্গুল তাক করে খলিফার বিলাসী জিনিস দেখাচ্ছিলেন তিনি, “আর ওদিকে আকসা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তাণ্ডব চালানো হয়েছে, ধর্ষণ করা হয়েছে। অথচ আপনার একটি আঙ্গুলও এতে নড়েনি!”

তিনি এমন এক ভাষণ দিয়েছিলেন যা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌কে ভয় করে এমন আলেমই দিতে পারে। কারণ তাঁর এই শক্ত বক্তব্য যদি কোনো বদ শাসকের উপর হয়, তাহলে বুঝতেই পারছেন তার কী অবস্থা হতে পারে। রাজনীতির বাস্তবতা তো আপনারা জানেনই।

খলিফা পর্যন্ত লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলেছে। কিছুই বলতে পারলো না। শুধু বিড়বিড় করে বলল, “কিছু একটা করবো ইনশাআল্লাহ।“

যেসব মানুষ ইতিহাস ঠিকমতো পড়ে না তারাই অতীতকে সিনেমার মতো মনে করে। সেই সময়ে খলিফার আসলে কোনো ক্ষমতাই নেই। সে কেউ না, পুতুল শুধুমাত্র। ইংল্যান্ডের রাণীর মতো। আসে যায়, মরে যায়, কেউ পাত্তা দেয় না। খলিফার তখন কোনো সেনাবাহিনীও ছিল না। সেই সময়ে খলিফা শুধুমাত্র দেখানোর জন্যেই খলিফা।

আমাদের ইতিহাসের বেশীরভাগ সময়ে, আব্বাসি খিলাফতের বেশীরভাগ সময়ে, এমনকি অটোমান খিলাফতেরও বড় সময় ধরে, আসল ক্ষমতা কখনোই খলিফার হাতে ছিল না। ওটা শুধুমাত্র একটি পদবি, একটি অফিসের নাম ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বরং ক্ষমতা তো ছিল পর্দার আড়ালের লোকেদের হাতে।

সেই সময়ের ক্ষমতাশালীরা ছিল মূলত সেলজুক বংশ। তাদের হাতেই সব ক্ষমতা, খলিফার হাতে কিছুই নেই। সেনাবাহিনীও নেই। এমনকি বাগদাদের কর্তৃত্বও নেই তার। তিনি তো শুধুমাত্র অনেক সম্পদওয়ালা একজন প্রতিনিধি মাত্র। তার হাতে কোনো ক্ষমতাই নেই। তবুও তিনি মিনমিন করে বললেন আর কি, যে কিছু করবেন। কিন্তু এতে কিছুই যায় আসে না।

পরের সপ্তাহে হারাউইকে খুতবা দিতে দেয়া হলো। চিন্তা করুন, সেই হইচই করবার পর তাকে খুতবা দিতে দেয়া হলো! তিনি খুতবা দিলেন। আর এমনই খুতবা দিলেন যে, বাগদাদের রাস্তায় রাস্তায় কান্নার রোল পড়ে গেলো। মানুষের মধ্যে আবেগ বেড়ে গেলো, কিছু একটা তো করতেই হবে। তিনি মানুষের আবেগ জাগিয়ে তুললেন।

***

আল-আকসা নিজেদের দখলে নিতে সক্ষম হলেও ক্রুসেডাররা কখনোই একতাবদ্ধ ছিল না। তারাও বহু দলে বিভক্ত ছিল। তাদের মধ্যে ইটালিয়ান ছিল, ফ্রেঞ্চরা ছিল। আরও ছিল ব্রিটিশ। সব স্থানে বিভিন্ন দল ছিল ওদের। প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন। প্রত্যেক দল ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের উপর রাজত্ব করছে। অল্প কয়েক বছরের মাঝেই উপকূল অঞ্চলগুলোতে ক্রুসেডারদেরই চার পাঁচ ছয় ধরণের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল।

এবার মুসলিমদের প্রধান প্রধান কিছু শহর — যেমন যেমন ধরুন হালাব বা আলেপ্পো — হুমকির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। তাই আবারও সমস্ত উলামা মিলে খলিফার কাছে আবেদন করবার চেষ্টা করলেন।

ভাববেন না যে, আগের যুগের শাসকরা আজকের তুলনায় ভালো ছিল। যেমন ধরুন, সেই সময়ে আলেপ্পো মানে হালাবের শাসক, তাকে কেউ ভালো হিসেবে জানতো না। ইতিহাসে তাকে কেউই প্রশংসা করেনি। তার নাম রুদওয়ান অথবা রিদওয়ান। দুঃখের বিষয় এই যে, যখন ক্রুসেডাররা ফিলিস্তিন আক্রমণ করতে আসছিল তখন এই রিদওয়ান নিজের ভাইয়ের সাথে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। কে কুরসিতে বসবে তা নিয়ে! এদিকে ক্রুসেডাররা আসছে। বাড়াবাড়ি করে বলছি না। তারা তাদের চোখের সামনে দিয়েই যেন চলে গেলো। একদম তাদের থেকে একটু দূরত্বে, অথচ এদের কোনো খবর নেই!

দুই আপন ভাই। তাদের বাবা গভর্নর ছিল। ছোট এক রাজবংশ। এখন কে ক্ষমতায় উঠবে? এই নিয়ে দুজনের মধ্যে যুদ্ধ লেগে গেছে। অথচ পাশ দিয়েই ক্রুসেডাররা ঢুকে পড়ছে। নিজেরা নিজেরাই মারামারি করলে ওদেরকে থামাবে কে?

এই রিদওয়ান ওই অঞ্চল চালায় সেসময়ে। আর বিশ্বাস করতে পারবেন! রিদওয়ান আসলে সেখানকার স্থানীয় ক্রুসেডার রাজবংশকে টাকা, স্বর্ণ ইত্যাদি দিয়ে খুশি করে রেখেছিল, যেন তার অঞ্চলে তারা আক্রমণ না করে!

হালাবের স্থানীয় লোকজন এই শাসককে বিশ্বাসঘাতক মনে করতো। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ওখানের প্রধান আলেম, ইবনুল খাশশাব। তিনি জনগনকে উত্তেজিত করে তুললেন, তাদের নিজেদের শাসক এই রিদওয়ানের বিরুদ্ধে।

ইবনুল খাশশাব একটি দল তৈরি করলেন। তাদের আবার পাঠালেন বাগদাদে প্রতিনিধিদল হিসেবে।

***

আল হারাউইর ঘটনার পর অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই আলেপ্পোর কাযী, ইবনুল হাশশাব একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করছেন। আবারও একজন আলেম একদল প্রতিনিধি নিয়ে গেলেন বাগদাদে। এটা মাত্র পাঁচ কি দশ বছর পরেরই ঘটনা।

ফিলিস্তিনের বিষয়টির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্যে যারা বাগদাদে আসলেন তারা মানুষের সামনে ভাষণ দিয়ে তাদেরকে উত্তেজিত করে তুলছিলেন। এরপরেও যখন কিছু হচ্ছিল না তখন সেই আন্দোলনকারীরা সহিংস হয়ে উঠলেন। কারণ শাসক কিছুই করছিল না। মুসলিম জনগন সহিংস হয়ে উঠলো। সরকারী সম্পত্তি ধ্বংস করা শুরু করে দিলো।

আমি যতদূর জানি, কোনো হতাহতের ঘটনা যদিও ঘটেনি, তবে তারা শহরে বেশ তাণ্ডব চালিয়েছিল। তখন জনগনের অনুভুতিতে সাড়া দিচ্ছে এমন কিছু দেখাতে সুলতানকে কিছু করতেই হলো।

শাসক যতো খারাপই হোক, দিনশেষে তারা সুনামের চিন্তা করেই। এটাই বাস্তবতা। আগেও এভাবে চলতো, এখনো এমনই চলে। তাদের কাজকে জায়েয করার জন্যে দিনশেষে জনগনের এক প্রকার সাপোর্ট তাদের লাগেই। এখন তাদের উদ্দেশ্য যেটাই হোক, সেটা আল্লাহ্‌র কাছে। কিন্তু আমাদের তো সাহায্য লাগবে, কিছু একটা করতে তো হবেই।

খলিফা সত্যি সত্যিই অনুরোধ করল। কাকে? সেলজুক সুলতানকে। খলিফা হলো আব্বাসি, আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর বংশধর। এর মানে হলো সে সাহাবী ইবনে আব্বাসেরও বংশধর, তাই না? ধরুন আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের ১০ বা ১৫ তম প্রজন্ম। অথচ তার হাতে কোনো ক্ষমতাই নেই। তাই সে নরম করে অনুরোধ করলো সুলতানকে, “আপনি কি দয়া করে কিছু করতে পারবেন? দেখছেন তো, মানুষজন কী শুরু করেছে!”

সেলজুক সুলতানকে মুসলিম জাহানের খলিফা অনুনয় বিনয় করে বলছে, যেন তিনি সেনাবাহিনী পাঠান। আর তিনি পাঠালেনও। প্রথম বাহিনী। আলেপ্পোকে ক্রুসেডারদের হাত থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে।

***

ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে এটাই হলো প্রাথমিক সফল যুদ্ধগুলোর একটি। ১১১৯ সালের এই যুদ্ধকে বলা হয় বালাতের যুদ্ধ। ইংরেজি ইতিহাসের বই খুঁজলে পাবেন একে বলা হচ্ছে ব্যাটল অফ দ্য ফিল্ড অফ ব্লাড। অর্থাৎ রক্তাক্ত প্রান্তরের যুদ্ধ।

এই যুদ্ধে মুসলিম সেনাসংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার। বেশীরভাগই সেলজুক। আর অন্যদিকে ছিল ইটালিয়ান ক্রুসেডার রাজা, Roger of Salerno।

এই যুদ্ধের ঠিক আগ মুহূর্তে ইবনুল খাশশাব আলেমদের বিশেষ পোশাক পরে ঘোড়ায় চড়ে উপস্থিত হলেন। ক্রুসেডাররা তাকে দেখে হাসছিল, “এই আলেম যুদ্ধে ময়দানে কী করে?” ইবনুল খাশশাব তখন মুসলিম সৈন্যদের দিকে ফিরলেন। আর ক্রুসেডারদের পেছনে রাখলেন। এরপর সবার উদ্দেশ্যে এমন খুতবা দিলেন, যা শুনে সমস্ত সৈন্য কাঁদতে শুরু করে দিলো।

আমরা ধারণা করতেই পারি যে, তিনি মসজিদুল আকসার কথা বলেছিলেন। তিনি অবশ্যই আল্লাহ্‌র রাস্তায় জিহাদের ফযিলতের কথা বলেছিলেন। ধারণা করতে পারি যে, তিনি শাহাদাতের ফযিলতের কথা বলেছিলেন।

পুরো সেনাবাহিনী আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল, কাঁদছিল অঝোরে! ক্রুসেডাররা এই অবস্থা দেখে বুঝে গেলো, এই আলেম কোনো সাধারণ মানুষ নন। যখন যুদ্ধ শুরু হলো, তিনি একদম প্রথম কাতারে ছিলেন। বিশ হাজারের বিরুদ্ধে দশ হাজার।

ক্রুসেডারদের ভয়ানক পরাজয় ঘটেছিল সেদিন। তাদের বিশ হাজার বাহিনীর বিশাল সংখ্যক নিহত হলো। মুসলিমদের হতাহতের সংখ্যা বেশ কম ছিল।

***

এই বিজয়ের কারণে চতুর্দিকে আশার বাণী ছড়িয়ে পড়লো যে, হ্যাঁ আমরা কিছু করতে পারবো। এই আশার ফলে পরবর্তীতে আরও অনেক ছোট বড় যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধের কারণেই সবার মধ্যে এই বোধ হলো যে, তারা সাহস করলে সম্ভব। চেষ্টা করলে জিততে পারবো।

এসব ছোটখাটো যুদ্ধের সাথে সাথে ইবনুল খাশসাবের মতো অনেক আলেমও ছিলেন যারা আল-আকসার চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাচ্ছিলেন।

তৎকালীন যুগের সবচাইতে বড় আলেমদের একজন ছিলেন ইবনে আসাকির। তিনিও দামেস্কের আলেম ছিলেন। আল-আকসার ফযিলত, শামের ফযিলত ইত্যাদি অনেকগুলো গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। এভাবেই তিনি পরিচিত হন সবার কাছে।

আরেকজন বিশাল আলেম ছিলেন। আমি তার নাম বা সেই বইটির নাম উচ্চারণ করছি না। কিন্তু যা বলতে চাচ্ছি তা বোঝার চেষ্টা করুন। আল্লাহ্‌র রাস্তায় সংগ্রাম নিয়ে লেখা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটি তিনি লিখেছিলেন। খুবই আবেগঘন, খুবই আবেগপূর্ণ বই এটা। এটা লেখাই হয়েছিল খুতবাতে প্রকাশ্যে পড়বার জন্যে। দুরুসে পড়বার জন্যে। ছোট্ট একটি বই। বিশালাকার কোনো গ্রন্থ না। বরং এই সংগ্রামের চেতনা জাগ্রত করার জন্যেই এটা লেখা হয়েছিল। পুরো মুসলিম বিশ্বে বইটি বেশ জনপ্রিয়। আজ অবধি এই বিষয়ের ওপর লিখিত সবচাইতে জনপ্রিয় বই এটা।

তো দেখুন, যখন মনে হয় কোনো আশাই আর বাকি নেই, কোনো আলোই আর নেই, তখনই এসব হচ্ছে। আলেমদের কিছু না কিছু করতেই হচ্ছে এই আলোকে জীবিত রাখবার জন্যে। মসজিদুল আকসা, ইসলামের হকিকত, জনগনের মনে ঈমান জাগ্রত তাদেরই রাখতে হবে।

***

আর সেই সুলতান যিনি আগে আলেপ্পোকে রক্ষা করতে সেনা পাঠিয়েছিলেন, এখন তিনি নতুন করে আবারও সেনাবাহিনী পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। এবার তিনি সেনাবাহিনী পাঠাতে চাচ্ছিলেন ইরাকের মসুলে। সেখানেও ক্রুসেডাররা আক্রমণ করেছিল।

তার একজন সামরিক জেনারেলকে তিনি সেখানে পাঠালেন। তার নাম ছিল মউদুদ। মউদুদ সেখানে এতোই সফল হয়েছিলেন যে, অভিযান চালাতে চালাতে তিনি আরও দক্ষিণে চলে গেলেন। সেখানকার প্রধান প্রধান দুর্গগুলোতে আক্রমণ করতে শুরু করে দিলেন। এভাবে করতে করতে তৎকালীন সময়ের সবচাইতে বিখ্যাত যুদ্ধে জড়িত হলেন। সানবারার যুদ্ধ। তার এই যুদ্ধ হয়েছিল জেরুজালেমের রাজা বাল্ডউইনের সাথে। ইংল্যান্ডের রাজা বাল্ডউইন তখন জেরুজালেমেরও রাজা। পুরো জেরুজালেমের দায়িত্বরত রাজার সাথে মউদুদ যুদ্ধে অবতির্ণ হতে পেরেছেন, সরাসরি! জেরুজালেমের ভেতর নয়, কিন্তু তবুও। শত্রু প্রধানের সাথে!

বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, তিনি জিতে গেলেন! জেরুজালেমে নয়, সেখান থেকেও অনেক দূরে। কিন্তু তবুও দেখুন বিষয়টা। ক্রুসেডারদের হারিয়ে দিচ্ছেন। যদিও এটা সম্পূর্ণ বিজয় ছিল না। তার পক্ষে প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল। তবে ক্রুসেডারদের ক্ষতি আরও অনেক বেশী ছিল।

রিদওয়ানের দিকে ফিরে আসি। রিদওয়ান কিন্তু চায়নি যে মুসলিমরা জিতে যাক। কারণ যেহেতু ক্রুসেডাররা তাকে রক্ষা করে চলছে, সে তো আরামেই আছে। যখন মউদুদের বাহিনী রিদওয়ানের শহরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, সে তাদের জন্যে শহরের দরজা খুলে দিতে অস্বীকার করলো! তাদেরকে খাদ্য পানি কিছুই দেয়নি!

এখন মউদুদ যেহেতু সফল হয়ে গেলেন, তিনি ভাবলেন আল-আকসাও জয় করবেন। কিন্তু তার আগে দামেস্কে ফিরে গেলেন খানিক বিশ্রাম নিতে। শক্তি সঞ্চয় করতে। এটা কিন্তু সালাহউদ্দিনের প্রায় ছয় যুগ আগের কথা। মউদুদের উদ্দেশ্য ছিল আল-আকসাকে মুক্ত করা। অথচ আমরা বেশীরভাগই মউদুদের নামও শুনিনি কখনো।

***

মউদুদ দামেস্কে এসেছেন। আর এই দামেস্কের শাসক ছিল রিদওয়ানের অধীনে। তখন একটা ঘটনা ঘটলো। এমন এক রহস্য হলো যার উন্মোচন হয়তোবা আমরা বিচার দিবসের আগে দেখতে পাবো না। মউদুদ যুদ্ধের কারণে খানিকটা আহত ছিলেন। তিনি সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু তাকে তো আল-আকসাতে যেতে হবে!

একদিন জুম্মার সালাতের পর শহরের সেই শাসক মউদুদের হাত ধরে হেটে যাচ্ছে। কোথা থেকে এক ঘাতক এসে তখন মউদুদকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে ফেললো। মউদুদ সেখানেই মারা গেলেন। কার বিরুদ্ধে বিজয়ের সপ্তাহখানেক পর? জেরুজালেমের রাজার বিরুদ্ধে বিজয়ের পর! দামেস্কেই হত্যা করা হলো তাকে।

লোকজন সাথে সাথেই রিদওয়ানকে দোষারোপ করতে লাগলো। সে বলছে, “না, আল্লাহর কসম! আমি করিনি!” সেই ঘাতককে ধরা হলো। আর খুব শীঘ্রই তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে গেলো। মউদুদও মরে গেলেন।

রিদওয়ানের দিনও একসময় শেষ হয়ে গেলো, সে-ও মারা গেলো। রিদওয়ান মরে যাবার পর ক্ষমতার শুন্যতা দেখা দেয়। আর এর ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই নতুন এক রাজবংশের উত্থান ঘটে। সেই রাজবংষের নাম আপনারা সবাই জানেন। জিংগি রাজবংশ।

এই জিংগিদের যুগে আলেমগন খুব প্রচার প্রচারণা চালাতেন। এই জিংগি বংশের যুগে প্রচুর প্রচুর আলেম মানুষদের আল-আকসার পক্ষে উত্তেজিত করতেন।

এরপর থেকে তো আমরা ঘটনা জানিই। ইমামুদ্দিন আয-জিংগি ভাবলেন, আমাকে আল-আকসা মুক্ত করতেই হবে। তিনি মারা গেলেন। এরপর নুরুদ্দিন জিংগি। তিনিও চেষ্টা করলেন। এরপর তিনি চলে গেলেন। এরপর এলেন সালাহউদ্দিন। তারপর তো বাকিটা ইতিহাস।

***

আমি যা বলে শেষ করতে চাই তা হলো —

ক্রুসেডের পর প্রথম দুই, তিন, চার দশকে যারা মারা গিয়েছিলেন, তারা কি বৃথাই মারা গিয়েছিলেন?

না। বরং তারা পরবর্তী ঘটনাচক্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। সানাবিল নামক এক ছোট যুদ্ধ মূলত মুসলিম-খৃষ্টান যুদ্ধের গতি বদলে দিয়েছিল, যদিও যুদ্ধটাকে সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। তবে এর ফলে মানুষ দেখেছিল যে, আরে! আমরাও তো জিততে পারি! মানুষের মনে এই আশার সঞ্চার হয়েছিল কারণ নেতৃস্থানীয় আলেমরা সাহস করে সরাসরি খলিফাদের সাথে কথা বলতে পেরেছিলেন, জনগণের মনে আল-আকসার চেতনা জীবিত রেখেছিলেন। আর মানুষের এই চেতনা এতোই শক্তিশালী ছিল যে, এমনকি উজির আর সুলতানদের পর্যন্ত কিছু না কিছু করতেই হয়েছে। আর এসব ছোটখাটো কাজগুলো একসময় এমন ঢেউ সৃষ্টি করলো যা করার উদ্দেশ্য শুরুতে খলিফার নিজেরও ছিল না।

সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে কোনো খলিফা নির্বাচিত করেননি। এই পয়েন্টটা বুঝতে হবে। আল-আকসাকে খলিফারা উদ্ধার করেননি। আল-আকসা রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে উদ্ধার হয়নি।

না! ক্ষমতার শূন্যতা যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছিল, তা শক্তিশালী সাহসী যোদ্ধা রাজপুত্রের জন্ম দিয়েছিল। তাদের অন্তরে ঈমান ছিল। আর এর ফলেই এই লোকগুলো — জিংগি আর সালাহউদ্দিন — এরাই চলে এসেছিলেন।

আমরা শুধুমাত্র কোনো অলৌকিক ঘটনার আশায় বসে থাকতে পারি না যে, হঠাৎ একদিন সালাহউদ্দিন আসবেন আর সব বদলে যাবে।

হ্যাঁ, একজন তো অবশ্যই আসবেন, কোনো সন্দেহ নেই। সেটাই আল্লাহ্‌র নিয়ম। কিন্তু সেই একজন আসবার আগ পর্যন্ত আমাদের সেই ভূমির স্মৃতি, সেই ভূমির চেতনা আর ফযিলত জীবিত রাখতে হবে। এই যে ব্যাপারটা এতো কষ্টের, এই যে হেরে যাবার বেদনা, হারিয়ে ফেলার কষ্ট, আমাদের ঈমানের এই যে বাস্তবতা, আমাদের তাকওয়ার বাস্তবতা, কিংবা আমাদের সবর অথবা আমাদের যেই সংগ্রাম — এ সবকিছুর মাধ্যমেই আমাদেরকে আল-আকসার চেতনা জীবিত রাখতে হবে। কারণ, এসব করার ফলেই অবশেষে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যখন ইনশাআল্লাহ পরিবর্তন ঘটবে।

অতএব, আপনার ভূমিকাকে তুচ্ছ মনে করবেন না। আপনার প্রভাবকে তুচ্ছ মনে করবেন না, তা যা-ই হোক না কেন। আমরা অনেকেই মউদুদের নাম শুনিনি। আমরা অনেকেই ইবনুল খাশশাবের নাম শুনিনি। আমরা অনেকেই আল হারাউইয়ের নাম শুনিনি। কিন্তু তাদের প্রভাব আল্লাহ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। আপনি যখন ইতিহাস পড়বেন, তখন এই বাস্তবতা দেখতে পাবেন।

সুতরাং, আল্লাহ সুবহানা ওয়া তায়ালা আমাদেরকে আমাদের সময়ের ইবনুল খাশসাব হওয়ার তৌফিক দান করুন, আমাদের যুগের হারাউই হওয়ার তৌফিক দিন। আমরা সেই পথে চলতে চাই। আর আল্লাহ যেন আমাদেরকে সেই দিন দেখান যেদিন আমাদের সালাহউদ্দিন ফিরে আসবেন।

আল্লাহ তাআলা মসজিদুল আকসাকে মুক্ত করুন।

অনুবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় Nouman Ali Khan Collection In Bangla ফেসবুক পেইজে। ঈষৎ সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত আকারে এটি এখানে প্রকাশ করা হলো।

***

ইংরেজিতে সম্পূর্ণ খুতবাটি শুনুন এখানে:

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান